পরিস্থিতিটা হাতের মুঠো থেকে ফস্কে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই বাধা দিল রানা মাগেনথেলারকে।
অত মানে আর এখন খুঁজে কি লাভ? বেকায়দা মত আটকে ফেলেছ। আমাদের। তোমার প্রেয়সী অস্থির হয়ে উঠেছে গুলি করবার জন্যে। খুন যখন। করতেই হবে, ওকে অনুমতি দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
ঠিক বলেছে লোকটা, ইরিনের মুখে দেঁতো হাসি।
দাঁড়াও। এক সেকেন্ড। ভাবতে দাও আমাকে। তুমি জানো যে আমিই ড্রাগরিঙের চীফ, তারপরেও এমন অরক্ষিত অবস্থায় ঢুকেছ কেন তুমি এই মৃত্যুফাঁদে? সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে মাগেনথেলার রানার চোখের দিকে। বাঁচবার পথ না থাকলে…
ঠিক এই কথাটাই বলতে যাচ্ছিলাম আমি তোমার সুন্দরী প্রেমিকাকে, জোর করে হাসি টেনে আনল রানা ওর ক্ষতবিক্ষত মুখে। ফিরল ইরিনের দিকে। গুলি করো, আপত্তি নেই, তবে এর মধ্যে খানিকটা কিন্তু রয়েছে। আমাকে আগে মারবে, না.আর কাউকে–সেটা বুঝে নেয়া দরকার প্রথমে। এই ঘরে আমার চেয়েও তোমাদের বড় শত্রু আরও কেউ থাকতে পারে–দেখো তো চেনা যায় কিনা?
অবাক দৃষ্টিতে সবার মুখের দিকে চাইল ইরিন। শুধু ইরিনই নয়, ঘরের প্রত্যেকেই তাই করল। রানা ছাড়া। সোজা সোহানার চোখের দিকে চাইল রানা। মাথাটা সামান্য একটু ঝুঁকল ওর ইরিনের দিকে। সহজ ভঙ্গিতে ইরিনের দিকে চাইল একবার সোহানা। রানা বুঝল, ওর বক্তব্য পরিষ্কার। অনুধাবন করতে অসুবিধে হয়নি সোহানার।
এইবার শেষ অস্ত্র ছাড়ল রানা।
গর্দভের দল! বলল সে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে। সহজ কথাটা বুঝতে এত দেরি হচ্ছে তোমাদের! ভেবে দেখার দরকার মনে করছ না একবার, এত খবর আমি পেলাম কোত্থেকে? খবর দেয়া হয়েছে আমাকে। তোমাদেরই একজন। দিয়েছে আমাকে সব খবর। এমন একজন, যার কলজে কাপিয়ে দিয়েছি আমি ভয় দেখিয়ে। সাধারণ ক্ষমার লোভে যে ভাসিয়ে দিয়েছে তোমাদের বানের জলে। এখনও আঁচ করতে পারছ না? আরে…ভলেনহোভেন!
তাজ্জব হয়ে চাইল সবাই ভলেনহোভেনের দিকে। মুহূর্তের জন্যে বোকা বনে গেছে যেন সবাই, বুঝে উঠতে পারল না রানার এই অদ্ভুত কথা বিশ্বাস। করা যায় কি যায় না। ভলেনহোভেনের বিস্ফারিত দুই চোখে অবিশ্বাস। হাঁ হয়ে গেছে মুখটা। সেই হাঁ অবস্থাতেই মৃত্যুবরণ করল লোকটা রানার গুলি। খেয়ে। ছোট্ট লিলিপুট পিস্তলটা বেরিয়ে এসেছে রানার হাতে-কড়াৎ করে। মৃত্যু বর্ষণ করেছে। সশস্ত্র ব্যক্তিকে শুধু জখম করবার ঝুঁকি নিতে পারেনি। রানা, শেষ করতে হয়েছে এক গুলিতেই। লাশটা হুড়মুড় করে চেয়ার থেকে মেঝেতে পড়বার আগেই খপ করে ইরিনের পিস্তল ধরা হাতটা ধরে ফেলল। সোহানা, ধরেই জুডোর কায়দায় হিপ হো করল। ছিটকে গিয়ে দরজার বাইরে লোডিং প্ল্যাটফর্মের উপর আছড়ে পড়ল ইরিন, পতন ঠেকাবার চেষ্টা করল কিছু একটা আকড়ে ধরে, কিন্তু কিছুইবাঁধলনা হাতে। রেলিং নেই লোডিং প্ল্যাটফর্মে। মর্মভেদী, তীক্ষ্ণ চিৎকার দ্রুত মিলিয়ে গেল নিচের দিকে।
এদিকে কর্নেল ভ্যান ডি গোল্ডকে মাগেনখেলারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখতে পেল রানা আড়চোখে। মাগেনথেলারের হাত থেকে পিস্তলটা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করছে সে। সফল হলে কি হলো না দেখবার সময় নেই, লুকা। বার্ষিনিকে পিস্তল বের করবার জন্যে পকেটে হাত দিতে দেখেই ডাইভ দিল। সে সামনের দিকে। পিস্তল বের করে ফেলেছে সে ঠিকই, কিন্তু সেটা ব্যবহার। করবার আগেই চেয়ার উল্টে পড়ে গেল পেছন দিকে। যখন উঠে দাঁড়াল, পিস্তল অদৃশ্য হয়ে গেছে ওর হাত থেকে। গলা দিয়ে অদ্ভুত একটা ঘড়ঘড়। আওয়াজ বেরোচ্ছে পেছন থেকে রানার বাম হাতটা গলা পেঁচিয়ে ধরায়, দুই চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে বাইরে।
উঠে দাঁড়িয়েই স্তম্ভিত হয়ে গেল রানা। দরদর করে রক্ত ঝরছে কর্নেল ডি গোল্ডের কপাল থেকে। পরমূহুর্তে বুঝতে পারল জখমটা মারাত্মক কিছু না। ঠিক রানার মতই পেছন থেকে ডি গোল্ডের গলা পেচিয়ে ধরে রয়েছে। ইন্সপেক্টর মাগেনথেলার। দুজনের পিস্তল তাক করে ধরা রয়েছে দুজনের দিকে, কিন্তু গুলি করলে মারা পড়বে নিজেরই লোক।
তুমি জানো, মাসুদ রানা, লুকা বার্যিনির মৃত্যুতে কিছুই এসে যাবে না আমার! হাঁপাতে হাপাতে বলল মাগেনথেলার, এবং আমি জানি, তোমার জেদের জন্যে মারা পড়ুক কর্নেল, সেটা তুমি কিছুতেই চাইতে পারো না। আমি চলে যাচ্ছি। যদি বাধাদাও, মারা পড়বে ডি গোল্ড। বুঝতে পেরেছ?
বুঝতে পারছি, বাধা না দিলেই বরং মারা পড়বে কর্নেল।
আমি কথা দিচ্ছি, মেজর রানা। অনুনয়ের মত শোনাল মাগেনথেলারের কণ্ঠ। আমাকে যদি এখন থেকে নির্বিঘ্নে বেরিয়ে যেতে দাও, গাড়িতে উঠেই ছেড়ে দেব আমি কর্নেলকে।
তোমাকে যদি বিশ্বাস করতাম, তবু তোমার কথায় রাজি হতাম না আমি।
এটা আমার জীবন-মরণ প্রশ্ন, মাসুদ রানা। খেপে উঠল মাগেনথেলার। বেপরোয়া আমি এখন। তুমি বুঝতে পারছ না…
বুঝতে আমি ঠিকই পারছি, মাগেনথেলার। আসলে তুমিই বোঝোনি কিছু। তোমাকে পালিয়ে যেতে দেয়ার জন্যে বাংলাদেশ থেকে এতদূর কষ্ট করে আসিনি আমি, হাদারাম! পালাবার সব পথ বন্ধ। এক পা নড়লেই গুলি খেয়ে মারা যাবে তুমি।
কি করে? কেঁপে গেল মাগেনথেলারের কণ্ঠ।
আরও একটা পিস্তল তাক করে ধরা রয়েছে তোমার দিকে। ওর চোখের উপর থেকে চোখ না সরিয়ে বলল রানা।