অথচ দেখা যাচ্ছে হয়ে বসে আছে, মৃদু হাসল রানা। আপনার বুকের দিকে ধরা ওই যে জিনিসটা দেখতে পাচ্ছেন ওর হাতে-ওটাকে আবার ললিপপ বলে মনে হচ্ছে না তো আপনার? আপনার রিভলভারটার দিকে হাত বাড়িয়েই দেখুন না একবার, ওই ললিপপটা যদি গর্জে না ওঠে তো আমার নাম নেই। কোন সন্দেহ নেই, কর্নেল, আপনার প্রিয় সহকর্মীই হচ্ছে গোটা ড্রাগ রিঙের পেছনের ক্রিয়েটিভ ব্রেন। সে-ই বস। লুকা বার্ষিনি হচ্ছে ওরই নিযুক্ত সাইকোপ্যাথিক মনস্টার। সম্প্রতি এই দানবকে বশে রাখা মুশকিল হয়ে পড়েছে, তাই না মাগেনথেলার? দাবার বোর্ডের বিশপ আর রাণী–বিগড়ে গেছে দুটো গুটিই। তাই না?
ঠিক। নিকোলাস রজারের দিকে চাইল মাগেনথেলার। এই এক চাহনিতেই বোঝা গেল কপালে দুঃখ আছে লোকটার। কঠোর দৃষ্টির সামনে। মুখ শুকিয়ে গেল ওর। ভলেনহোভেনের সাথে সাথে সে-ও কেন পিস্তলটা বের করেনি সেজন্যে খুব সম্ভব দুঃখ হচ্ছে ওর এখন। কিন্তু এখন আর পিস্তল বের করা যায় না। স্পষ্ট বোঝা গেল, অসহায় বোধ করছে লোকটা। এ ইরিনের দিকে চাইল রানা। রানার চোখের দৃষ্টিতে স্নেহের বিন্দুমাত্র ছিটেফোঁটাও নেই।
তোমার দাবার বোর্ডের রাণীএকেবারেই বিগড়ে গেছে, মাগেনথেলার। তোমার উপপত্নী ঘুমোচ্ছে এখন আরেকজনের সাথে। সুযোগ পেলেই..
উপপত্নী! এবার সম্পূর্ণভাবে ভারসাম্য হারাল কর্নেল ডি গোল্ড,। ইরিনকে তুমি বলছ মাগেনথেলারের কেপ্ট?
যাকে বলছি সে তো রাগ করছে না কথাটা শুনে। কেন? তার কারণ। কথাটা স্বীকৃত সত্য। কিন্তু ইদানীং রেভারেন্ড রজারের সাথে ভাবটা তার অতিরিক্ত গম্ভীর হয়ে উঠেছে। আত্মার মিল পেয়েছে ও সাইকোপ্যাথ বার্যিনির মধ্যে। চমৎকার ঘোল খাইয়েছে ইরিন আপনাকে, কর্নেল। পুরোটা ব্যাপারই প্ল্যান করা। নেশার কবলে পতিত অসহায় বালিকা ছিল না ও কোনদিনই। হাতের দাগগুলোও নকল। ওর মানসিক বয়স আট বছরের শিশুর সমান নয়, খোদ শয়তানের সমান। এবং মানুষটা শয়তানের দ্বিগুণ পাজি।
কী জানি, বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল ডি গোল্ড। কিছুই। ঢুকছে না আর আমার মাথায়।
তিনটে ব্যাপারে মাগেনথেলারের প্রয়োজন ছিল ইরিনকে, সহজ করে। বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল রান্যা। ওই রকম একটা মেয়ে যার, নিমেষে সে সন্দেহাতীত চরিত্রে পরিণত হয় সবার কাছে। মেয়েটার অবস্থার কথা জানলে যে-কেউ ধরে নেবে যে ড্রাগ রিঙ ধ্বংস করে দেয়ার জন্যে একান্ত নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাচ্ছে মাগেনথেলার, যেমন করে তোক প্রতিশোধ গ্রহণ করতে চায় সে যারা ওর মেয়ের সর্বনাশ করছে তাদের ওপর। দ্বিতীয়ত, নিকোলাস রজারের সাথে মাগেনথেলারের যোগাযোগের একমাত্র সূত্র ছিল ইরিন। রজারের সাথে মাগেনথেলারের দেখা করবার তো প্রশ্নই ওঠে না, টেলিফোন বা চিঠিতেও যোগাযোগ করা নিরাপদ মনে করেনি ওরা–ইরিনের মাধ্যমে চলত আদানপ্রদান। কিন্তু সবচেয়ে জরুরী যে কাজটা করত ইরিন, সেটা হচ্ছে ড্রাগ সাপ্লাই। হাইলারে গিয়ে খালি পুতুল বদলে হেরোইন ভরা পুতুল নিয়ে আসত, ভভেল পার্কের ভ্যানে সে পুতুল বদলে নিত একই চেহারার আরেকটা পুতুলের সাথে। এইভাবে অপূর্ব এক পুতুল খেলা দেখাচ্ছিল সে গত তিন বছর ধরে। কিন্তু ছোট্ট একটা ভুল করেছিল এই আশ্চর্য প্রতিভাময়ী অভিনেত্রী। চোখে বেলেডোনা ড্রপ দিয়ে অ্যাডিক্টের মত চকচকে অথচ অন্তঃসারশূন্য ভাবটা আনবার চেষ্টা করেছিল সে! তখন বুঝিনি, কিন্তু পরে। আরও দুই-একজন নেশাখোরের চোখ দেখে টের পেয়ে গেলাম আমি ওর অভিনয়। টের পেলাম, ও আসলে পালিতা কন্যা নয়, মাগেনথেলারের। প্রেমিকা। বুঝলাম আপন ভাই ও স্ত্রীকে হত্যা করেছিল মাগেনথেলার এই, ইরিনকে পাওয়ার জন্যেই।
কবে কবে টের পেলেন যে আমি এর সাথে জড়িত? জিজ্ঞেস করল মাগেনথেলার। ভুরুজোড়া কৌতুকের ভঙ্গিতে সামান্য কুঁচকে আছে।
অনেক দেরিতে, বলল রানা। সবই বুঝি আমি, কিন্তু একটু দেরিতে। পুলিস কার দেয়া হয়েছিল আমাকে আপনারই বুদ্ধিতে। মনে আছে? তারপর। থেকে আপনারা আর আমার ওপর নজর রাখবার প্রয়োজন বোধ করলেন না। কারণ, গাড়িতে লুকিয়ে রাখা ট্রান্সমিটারের সাহায্যে আমার গতিবিধি নখদর্পণে রেখেছিলেন আপনি সর্বক্ষণ। কিন্তু পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারলাম তখনি…
ঠিক এমনি সময়ে ঝট করে রানার দিকে ফিরল কর্নেল ডি গোল্ড। বোকার মত প্রশ্ন করে বসল, তাহলে? যদি আগে থেকেই সব জানবেন, তাহলে এইরকম অরক্ষিত অবস্থায় এখানে…
প্রমাদ গুণতে যাচ্ছিল রানা, এমনি সময়ে ওকে উদ্ধার করল ইরিন। হঠাৎ অসহিষ্ণ কণ্ঠে বলে উঠল, ভ্যাজর ভ্যাজর একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না? সোজা চাইল মাগেনথেলারের চোখের দিকে। এই দুটোকে খতম করে। দিলেই তো চুকে যায়। আর বাজে সময় নষ্ট না করে
দাঁড়াও! ইরিনকে পিস্তলটা একটু উপরে তুলতে দেখে বাম হাত তুলে থামবার ইঙ্গিত করল মাগেনথেলার। রানার দিকে এগিয়ে এল এক পা। বিস্মিত হলো রানাঃলোকটার বুদ্ধির তীক্ষ্ণতা দেখে। জরুরী পয়েন্টটা ধরতে। পেরেছে সে ঠিকই। জিজ্ঞেস করল, সেই জন্যেই তুমি আমার সামনে। উচ্চারণ করেছিলে কোড ওয়ার্ড মাদাগাস্কারের কথা। তুমি জানতে যে ওই কোড ওয়ার্ড ব্যবহার করে সোহানা চৌধুরীকে ওর হোটেল কামরা থেকে বের করে আনতে পারি আমরা। তার মানে…