বারকয়েক মুখ খুলল এবং বন্ধ করল নিকোলাস রজার, কোন আওয়াজ বেরোল না মুখ থেকে।
পিস্তলটা তুলল রানা। সোজা চাইল রজারের চোখের দিকে।
এইবার। রেভারেন্ড বার্যিনি। তুমি প্রস্তুত?
মাথার উপর তুলে ধরা হাত দুটো কাঁপতে শুরু করল রজারের, দুই চোখে দেখা দিল মৃত্যুভীতি। পরিষ্কার বুঝতে পেরেছে সে, এক্ষুণি টিপে দেবে রানা পিস্তলের ট্রিগার।
সাবধান, মাসুদ রানা! হঠাৎ চিৎকার করে উঠল কর্নেল ডি গোল্ড। নিজের হাতে আইন তুলে নিতে দেয়া হবে না আপনাকে।
ওকে বাঁচিয়ে রাখবার কোন অর্থই হয় না কর্নেল, ওকালতি করছে যেন। রানা। দিই শেষ করে। আপনারা বলতে পারবেন, পালাবার চেষ্টা করতে গিয়ে গুলি খেয়ে মারা গেছে লুকা বার্যিনি।
আর একটু তুলল রানা পিস্তলটা। ঠিকরে বেরিয়ে আসবে বলে মনে হলো নিকোলাস রজারের চোখ। ঠিক এমনি সময়ে দিনের তৃতীয় কণ্ঠস্বর শুনতে পেল রানা পেছন থেকে।
পিস্তল ফেলে দিন, মেজর রানা।
হাত থেকে ছেড়ে দিল রানা পিস্তলটা। খটাং করে মেঝের উপর পড়ল সেটা। ধীরে ধীরে ঘুরল সে পেছন দিকে। একটা র্যাকের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল ইরিন মাগেনথেলার। ডানহাতে ধরা রয়েছে একটা লুগার। সোজা রানার বুকের দিকে তাক করা।
.
১০.
ইরিন! ভুরুজোড়া মাঝ-কপালে উঠে গেল কর্নেল ডি গোল্ডের। ব্যাপারটা কি ঘটে গেল কিছুতেই মাথার মধ্যে ঢুকছে না তার। হায় খোদা! তুমি কোত্থেকে…তোমার হাতে… হঠাৎ থেমে গিয়ে ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠল কনেল। খটাং করে কব্জির উপর এসে পড়েছে একটা পিস্তলের বাট। হাত থেকে খসে। পড়ে গেল রিভলভার। হতবুদ্ধি বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে সে আক্রমণকারীর মুখের দিকে। ইন্সপেক্টর মাগেনথেলার! পিস্তলটা সোজা ধরা রয়েছে ডি গোল্ডের বুকের দিকে। মাথার উপর থেকে হাত নামিয়ে আনছে। ভলেনহোভেন আর নিকোলাস রজার। মুহূর্তের মধ্যে একটা পিস্তল বেরিয়ে এল ভলেনহোভেনের হাতে। বিভ্রান্ত কণ্ঠে বলল কর্নেল, এসব…এসব কি হচ্ছে, মাগেন…
শাট আপ, ধমকে উঠল ইন্সপেক্টর মাগেনথেলার। বসে পড়ো মেঝের ওপর। দ্রুতহাতে সার্চ করল সে রানাকে, অস্ত্র না পেয়ে বলল, তুমিও, মাসুদ রানা। এমনভাবে বসবে যেন হাতদুটো সর্বক্ষণ দেখতে পাই আমি।
বসে পড়ল রানা আর ডি গোল্ড। পদ্মাসনের মত পা ভাজ করে বসল রানা, বাহু দুটো রাখল উরুর উপর, ডানহাতটা আলতোভাবে ঝুলছে পায়ের। গোড়ালির কাছে। মেঝের উপর থেকে রানার পিস্তল এবং কর্নেলের রিভলভারটা তুলে নিজের কোমরে গুজল মাগেনথেলার।
এত দেরি করলে কেন, ইরিন?অনুযোগের কণ্ঠে প্রশ্ন করল রেভারেন্ড রজার। ধকলটা পুরোপুরি সামলে নিতে পারেনি এখনও। আর একটু দেরি করলেই খতম হয়ে যেতে পারতাম, তা জানো? একটা রুমাল বের করে ঘাম মুছল কপালের।
উহ! দারুণ জমেছিল মজাটা! প্রতিটা মুহূর্ত উপভোগ করেছি আমি। সোহানার দিকে চাইল, তারপর চাইল ভলেনহোভেনের দিকে। যে পর্যন্ত এসে স্থগিত রাখতে হলো বাধা পড়ায়, আবার সেখান থেকেই শুরু করা যাক, কি বলেন?
চকচকে চোখে সোহানার উপর একবার লোলুপ দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে লজ্জার ভান করল ভলেনহোভেন, সবার সামনে? তুমি আড়ালে লুকিয়ে দেখতে চেয়েছিলে, সে ছিল এক কথা…আর বার্যিনি আমার বাল্যবন্ধু, ওর সামনে কোন লজ্জা নেই, কিন্তু এত লোকের সামনে কাপড় ছাড়তে…
ব্যাপারটা সবাই বুঝতে পারছে না দেখে একটু ব্যাখ্যা করল রেভারেন্ড রজার, ওরফে লুকা বার্যিনি।
ভলেনহোভেনটা একটু কামুক প্রকৃতির। আমিও ভেবে দেখলাম, মেরে যখন ফেলাই হবে, তার আগে যদি মিস সোহানা চৌধুরীকে একটু আনন্দ দেয়া যায়, আমার তো কোন ক্ষতি হচ্ছে না তাই রাজি হয়ে গেলাম। মিস শেরম্যানকেও এইরকম আনন্দ দান করা হয়েছিল গলায় রশি বেঁধে ঝুলিয়ে দেয়ার আগে। একেই বা বঞ্চিত করি কেন? দশটা মিনিট সময় পেলেই কাজ সেরে বেরিয়ে পড়তাম আমরা এখান থেকে–কিন্তু বাধ সাধল এই হারামী লোকটা। রানার দিকে চেয়ে নিষ্ঠুর একটুকরো হাসি ফুটে উঠল রজারের মুখে। হ্যালো, মাসুদ রানা?. এবার আপনি পরমেশ্বরের ডাক শুনতে পাচ্ছেন?
এসব…এসব কি দেখছি, কি শুনছি, মেজর রানা? বিহ্বল দৃষ্টিতে চাইল কর্নেল রানার মুখের দিকে।
এই প্রসঙ্গে আসছিলাম আমি, বলল রানা। একটু পরেই আমি আপনাকে জানাতাম কেন গত কয়েক বছর ধরে এদের কার্যকলাপের কিছুই টের পাননি আপনি। কেন হাজার চেষ্টা করেও এক কদমও এগোতে পারছে না অ্যামস্টার্ডাম-পুলিস। তার একমাত্র কারণ, আপনার পরম বিশ্বস্ত সহকারী, এখানকার নারকোটিক ব্যুরোর চীফ, শ্রীমান মাগেনথেলার বিশেষভাবে লক্ষ্য রেখেছেন যেন কারও পক্ষে এক পা-ও অগ্রসর হওয়া সম্ভব না হয়। শুনলে অবাক হবেন আপনার প্রিয় ইন্সপেক্টর মাগেনথেলারই হচ্ছেন নাটের আসল গুরু, বাকি সবাই তার কুইন, বিশপ, নাইট, পন।
মাগেনথেলার? চোখের সামনে প্রমাণ পেয়েও কথাটা বিশ্বাস করে। উঠতে পারছে না কর্নেল পুরোপুরি। একজন সিনিয়র পুলিস অফিসার যে। এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে, বিশেষ করে মাগেনথেলারের মত। একজন কঠোর নীতিপরায়ণ লোক যে এই কাজ করতে পারে, সেটা কর্নেলের। ধারণার এতই বাইরে ছিল যে সব দেখার পরেও ভেতরে বিশ্বাস আসতে চাইছে না। এটা কি করে সম্ভব। এটা হতেই পারে না!