হঠাৎ থেমে গেল এঞ্জিনের শব্দ। রেঞ্চটা ঝুলের শেষ সীমায় পৌঁছে নেমে আসছে আবার। সড়সড় করে আরও তিনফুট আন্দাজ ঢিল দিল রানা নাইলন কর্ডে। হঠাৎ টের পেল প্রহরী যে কিছু একটা গোলমাল হয়ে গেছে কোথাও। কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে অনেক। কিছু একটা সন্দেহ করে চট করে ঘাড় ফিরিয়ে চাইল সে উপরদিকে। সাথে সাথেই দড়াম করে কপালের উপর এসে পড়ল স্টীলসন রেঞ্চ। শব্দ শুনে রানার মনে হলো ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। লোকটার মাথার খুলি। রশি ধরে টেনে রেঞ্জটা তুলে আনতে আনতে দেখল, জানালার চৌকাঠের উপর দুই ভাঁজ হয়ে ঝুলে রয়েছে লোকটা বেড়ার গায়ে শুকোতে দেয়া কাপড়ের মত।
কর্নেল ডি গোন্ড আর ইন্সপেক্টর মাগেনথেলারকে দেখতে পেল রানা। দ্রুতপায়ে এগোচ্ছে এইদিকে। ডানহাতে ওদের আরও দ্রুত আসবার ইঙ্গিত করে জুতোর মধ্যে গোঁজা পিস্তলটা ঠিক আছে কিনা দেখে নিয়ে শুয়ে পড়ল, রানা হয়েস্টিং বীমের উপর, তারপর পকেট থেকে পিস্তলটা বের করে কামড়ে ধরল দাঁতের ফাঁকে। এবার দুই হাতে বীমটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ঝুলে পড়ল নিচের দিকে। বার দুয়েক দোল খেয়ে সামনের দিকে এগোবার সময়। হাত ছেড়ে দিল রানা।
লোডিং প্ল্যাটফর্মের রেলিং নেই, কাজেই কয়েকটা কাজ একসাথে করতে হলো রানাকে। বাম পা প্ল্যাটফর্ম স্পর্শ করবার সাথে সাথেই ডান পা দিয়ে জোরে একটা লাথি মারল সে দরজার গায়ে, দরজাটা হা হয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই বাম হাতে চট করে চৌকাঠ ধরে বাচল ছিটকে নিচে পড়ে যাওয়া থেকে। ততক্ষণে ডানহাতে চলে এসেছে পিস্তল। দ্রুত বারতিনেক চোখ মিটমিট করে সহ্য করে নিল ঘরের উজ্জ্বল আলো, তারপর পিস্তল হাতে ঢুকল ঘরের ভেতর।
ঘরের ভেতর বসে আছে দুইজন, দাঁড়িয়ে রয়েছে সোহানা। সোহানার পরনে ব্রেসিয়ার আর ছোট্ট জাঙিয়া, মাথার চুল মস্ত এক খোঁপায় বাধা নগ্ন ক্ষীণ কটি জড়িয়ে ধরে, আছে বিশাল মোটা ভলেনহোভেনের। থলথলে হাত, সোহানার নাভির কাছে নাক ঘষছে, আর ভুঁড়ি কাপিয়ে ২।< লোকটা অশ্লীল হাসি। ছটফট করছে সোহানা, একেবেঁকে ওর হাত থেকে নিজেকে মুক্ত করবার চেষ্টা করছে। কাছেই একটা চেয়ারে বসে মসৃণ হাসি হাসছে রেভারেন্ড ডক্টর নিকোলাস রজার।
দেখতে দেখতে বদলে গেল সবার চেহারা। ভলেনহোভেনের হাসিটা মুখ থেকে ধাপে ধাপে মিলিয়ে গিয়ে কদাকার ভীতির ছাপ ফুটে উঠল ওর মুখের উপর। রানাকে দেখার সাথে সাথেই ভূত দেখার মত চমকে উঠল নিকোলাস। রজার, মুহূর্তে হা হয়ে গেল মুখ, বিস্ফারিত চোখে চেয়ে রইল সে রানার মুখের দিকে। ফ্যাকাসে হতে হতে ওর মাথার পাকা চুলের মতই সাদা হয়ে গেল। ওর মুখটা। দুই পা এগিয়ে গেল রানা ঘরের ভেতর। কয়েক সেকেন্ড অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টিতে রানার মুখের দিকে চেয়ে ছিল সোহানা, রানাকে নড়ে উঠতে দেখেই এক ঝটকায় কোমর থেকে ভলেনহোভেনের হাত ছাড়িয়ে প্রায় উড়ে এসে পড়ল ওর বুকে। সোহানার বুকের ভেতর কী জোরে হাতুড়ি পিটছে টের পেল রানা। মৃদু দুটো চাপড় দিল- সে ওর পিঠে, তারপর মুচকে হাসল। রজারের দিকে চেয়ে।
হ্যালো, রেভারেন্ড? পরমেশ্বরের ডাক শুনতে পাচ্ছেন?
যা বোঝার বুঝে নিয়েছে দুজনই। বিনা বাক্যব্যয়ে হাত তুলল দুজন মাথার উপর। পিস্তলটা দুজনের-ঠিক মাঝ বরাবর তাক করে ধরে চুপচাপ। দাঁড়িয়ে রইল রানা ডি গোল্ড আর মাগেনথেলারের অপেক্ষায়। ধুপধাপ। জুতোর আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে সিঁড়িতে। রিভলভার হাতে হুড়মুড় করে প্রথমে ঢুকল কর্নেল, হাঁপাচ্ছে হাঁ করে; তার পেছন পেছন ঘরে ঢুকল ইন্সপেক্টর মাগেনথেলার, ভাবের লেশমাত্র নেই মুখের চেহারায়, পাথর।
এসব কি! তাজ্জব চোখে উপস্থিত সবার মুখের উপর দৃষ্টি বোলাল ভ্যান। ডি গোল্ড। এই দুই ভদ্রলোকের দিকে পিস্তল ধরে রেখেছেন কেন? আপনার…
ব্যাখ্যা করে বললেই সব বুঝতে পারবেন, কর্নেল। নিরুত্তাপ কণ্ঠে বলল রানা।
ঘোলাটে কোন ব্যাখ্যায় চলবে না, মেজর রানা, বলল মাগেনথেলার। কেন আপনি শহরের দুজন অত্যন্ত উচ্চ সম্মানিত, নামজাদা নাগরিককে…
আর হাসাবেন না, ইন্সপেক্টর, বলল রানা। গাল কোচকালেই ব্যথা লাগছে।
সেটারও ব্যাখ্যা দরকার। বলল ডি গোল্ড। আপনার চেহারার এই হাল…
সব বলছি। শুরু করতে পারি?
দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা ঝাঁকাল ডি গোল্ড।
আমার নিজস্ব ভঙ্গিতে?
আবার মাথা ঝাঁকাল কর্নেল।
সোহানার দিকে ফিরল রানা। তুমি জানো, মারা গেছে মারিয়া?
জানি। এই একটু আগেই বলছিল লোকটা। রজারের দিকে চাইল সোহানা। বলছিল, আর হাসছিল। তোমার মৃত্যুর খবরও পেয়েছিলাম ওর কাছেই। ও বলছিল, ঘড়িঘরের মধ্যে…।
আমার ব্যাপারে ভুল বুলেছিল। ওর জানা ছিল না যে ইলেকট্রিক কারেন্ট ফিউজ করে দিয়ে কোনমতে বেঁচে গিয়েছি আমি এ যাত্রা ওর হাত থেকে। তবে মারিয়ার ব্যাপারে ঠিকই বলেছে ও। আমার চোখের সামনে হে ফর্ক দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়েছে ওকে। ডি গোন্ডের দিকে ফিরল রানা। এই নিন, বিট্রিক্স শেরম্যানের হত্যাকারীকে তুলে দিচ্ছি আমি আপনার হাতে। সাইকোপ্যাথিক কিলার রেভারেন্ড ডক্টর নিকোলাস রজার। সমস্ত তথ্যপ্রমাণ রয়েছে আমার কাছে। এ-ই হচ্ছে বিট্রিক্স শেরম্যান, হেনরী শেরম্যান আর। ইসমাইল আহমেদের হত্যকারী। এরই ইঙ্গিতে আজ দুপুরে মোরব্বার মত করে হে-ফর্ক দিয়ে কেচে মারা হয়েছে মারিয়াকে।