শহরে পৌঁছুতে পৌঁছুতে সন্ধে হয়ে গেল। পুরানো শহরের দিকে চলল। রানা যত দ্রুত সম্ভব। ওয়েরহাউজের রাস্তাটা একেবারে ফাঁকা। রাস্তায় একটা জনপ্রাণীও নেই বটে, কিন্তু ভলেনহোভেন, কোম্পানীর তেতলার একটা জানালায় লোক দেখতে পেল রানা। উইন্ডো-সিলের উপর কনুই রেখে রাস্তার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত চোখ বোলাচ্ছে একজন তাগড়া চেহারার লোক। হাওয়া খাওয়ার উদ্দেশ্যে যে নয়, বুঝতে অসুবিধে হলো না রানার। দালানটার সামনে দিয়ে গতি, পরিবর্তন না করে এগিয়ে গেল রানা, গলির শেষ মাথায় গিয়ে মোড় নিল ডাইনে। ড্যামের কাছাকাছি ফিরে গিয়ে একটা পাবলিক টেলিফোন। বুঁদ থেকে ডায়াল করল কর্নেল ডি গোল্ডের নাম্বারে।
সারাটা দিন কোথায় ছিলেন আপনি? রানার গলা শুনেই বিরক্ত কণ্ঠে বলল কর্নেল। কোথায় কি করে বেড়াচ্ছেন, এদিকে আমরা দুশ্চিন্তায়…
অত চিন্তার কি আছে? আমি তো আর ছোট্ট খোকা নই! গলার স্বর। পরিবর্তন করল রানা। আমার ইনভেস্টিগেশন কমপ্লিট। সবকিছু জানাবার জন্যে প্রস্তুত আমি এখন।
দ্যাটস গুড! জানান।
এখানে নয়। টেলিফোনে বলা যাবে না। ইন্সপেক্টর মাগেনথেলারকে নিয়ে আপনি এক্ষুণি ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানীতে চলে আসতে পারবেন? আমি এখন ওখানে চলেছি।
ওখানে আপনি সবকিছু জানাবেন আমাদের?
কসম।
বেশ। আসছি।
একটা কথা-প্লেন ভ্যানে করে আসবেন। গলিমুখেই ভ্যান ছেড়ে দিয়ে হেঁটে ঢুকবেন গলিতে। প্রহরী রয়েছে ওদের তেতলার জানালায়।
প্রহরী?
হ্যাঁ। তবে ওকে অন্যমনস্ক করবার ব্যবস্থা আমি করব। আপনারা রওনা হয়ে যান।
সাথে আরও লোক আনব?
না। শুধু আপনারা দুজন।
রিসিভার নামিয়ে রেখে একটা স্টোর থেকে এক পাউন্ড নাইলন কর্ড কিনল রানা, সেই সাথে কিনল বড়সড় একটা পানির পাইপ টাইট দেয়ার ভারী রেঞ্চ। পাঁচ মিনিটের মধ্যে ভলেনহোভেন কোম্পানীর একশো গজের মধ্যে পার্ক করে রাখল রানা অস্টিনটা–ওই গলি দিয়ে না ঢুকে তার আগের গলিটা দিয়ে ওয়েরহাউজের পেছন দিকে চলে এসেছে সে। দুই সমান্তরাল গলি কিছুদূর অন্তর অন্তর দুটো সুইপার প্যাসেজ দিয়ে পরস্পর যুক্ত, আগেই লক্ষ। করেছিল রানা। প্রথম প্যাসেজ দিয়ে কিছুদূর গিয়েই একটা ফায়ার-এসকেপ দেখতে পেল সে। কিন্তু এটার সাহায্যে ছাদে উঠলে ভলেনহেভেন কোম্পানীর দালানটা বেশ অনেকটা দূর পড়ে যাবে মনে করে পুরো গলিটা খুজল সে কাছাকাছি আর কোন ফায়ার-এসকেপ পাওয়া যায় কিনা। পাশের গলিটাও দেখল–কিন্তু আর একটাও ফায়ার-এসকেপ চোখে পড়ল না ওর।
ফিরে এসে অপ্রশস্ত, অন্ধকার কাঠের সিঁড়ি বেয়ে একেবারে ছাতে উঠে পড়ল রানা। পিচ্ছিল ছাতের উপর দিয়ে হেঁটে কিনারে চলে এল। ছয়সাতটা, বাড়ি ডিঙোলে পৌঁছুবে সে লক্ষ্যস্থলে। এই ছাতের থেকে পাশের বাড়ির ছাতের দূরত্ব ছয়ফুট, লাফ দেয়া ছাড়া ডিঙোবার আর কোন উপায় নেই। লাফ দেয়ার মুহূর্তে যদি দয়া করে পা-টা একটু পিছলায়, তাহলেই সব খেলা। শেষ–হুড়মুড় করে পড়বে গিয়ে ষাট ফুট নিচে। আবছা আঁধারে ধোকা লাগছে চোখে; তবু আল্লা ভরসা বলে তিন কদম দৌড়ে লাফ দিল, রানা। এইভাবে টপকাতে গিয়ে চতুর্থ ছাতে এসে পিলে চমকে গেল ওর, যখন ছয়ফুট আন্দাজের লাফ দিয়ে দেখল পাশের ছাতটা আট ফুট দূরে। ভাগ্যিস ফুট দুয়েক মার্জিন রেখেই দিয়েছিল লাফটা–একেবারে কিনারে পড়েই চট করে হাঁটু ভাজ করে বসে হামাগুড়ি দিয়ে সরে গেল মাঝের দিকে। আর দুটো.ছাত. পেরিয়ে পৌঁছে গেল সে ভলেনহোভেনের মাথায়। রাস্তার দিকে কিনারায় গিয়ে সামনে ঝুঁকে দেখল, ঠিক জায়গাতেই পৌঁছেছে, প্রায় পঁচিশ-তিরিশ ফুট নিচে। জানালা দিয়ে মাথা বের করে রেখেছে লোকটা। একবার এপাশে তাকাচ্ছে, একবার ওপাশে।
স্টীলসন রেঞ্চের হাতলের শেষ মাথার ফোকরে নাইলন কর্ডের একমাথা বাঁধল রানা শক্ত করে। তারপর হয়েস্টিং বীম থেকে বেশ কিছুটা তফাতে শুয়ে পড়ল ছাতের কিনারে বুক পর্যন্ত রাস্তার দিকে বের করে। বিশফুট আন্দাজ রেঞ্চটা নামিয়ে দোলাতে শুরু করল সে পেন্ডুলামের ভঙ্গিতে। প্রতিটা দোলের সাথে সাথেই রানার হাতের ছোট্ট একটা টান পড়ছে, ফলে ক্রমেই বাড়ছে ওটার গতিবেগ। যত দ্রুত সম্ভব কাজ সারবার তাগিদ অনুভব করছে। রানা, হয়েস্টিং বীমের ঠিক নিচেই পাঁচতলার যে লোডিং প্ল্যাটফর্ম, তার পাশের ভেড়ানো দরজার ফাঁক দিয়ে উজ্জ্বল আলো দেখতে পাচ্ছে সে। যে কোন মুহূর্তে খুলে যেতে পারে দরজাটা। কেউ যদি প্ল্যাটফর্মে এসে দাঁড়ায়, পরিষ্কার দেখতে পাবে রানাকে।
কমপক্ষে তিনসের ওজন হবে রেঞ্চটার। প্রায় নব্বই ডিগ্রী কোণ সৃষ্টি করে দুলছে এখন। সাবধানে আরও কয়েক ফুট নামিয়ে দিল রানা ওটাকে। ভয়। হলো কখন না জানি লোকটা আবার উপরদিকে চায়। মাথার উপর দিয়ে পার। হয়ে যাওয়ার সময় নিশ্চয়ই কিছু না কিছু শব্দ হচ্ছে, কানে গেলেই চট করে চাইবে লোকটা উপরে।
কিন্তু লোকটার খেয়াল এদিকে থাকলে তো টের পাবে! ওর সমস্ত মনোযোগ এখন গলির মুখের দিকে। গলিটা পেরিয়েই থেমে দাঁড়িয়েছে একটা নীল ভ্যান। যদিও দেখা যাচ্ছে না ওটাকে, এঞ্জিনের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে স্পষ্ট।, এর ফলে দুদিক থেকে সুবিধে হলো রানার। তেতলার প্রহরী ব্যাপারটা। ভালমত বোঝার জন্যে মাথাটা আর একটু বের করল সামনের দিকে। আর এঞ্জিনের গুঞ্জন ঢেকে দিল ওর মাথার উপর দোদুল্যমান রেঞ্চের বাতাস কাটার শব্দ।