দশ সেকেন্ডের মধ্যে বাধন খুলে দেয়া হলো রানার হাত-পায়ের। এয়ারফোন খুলতে গিয়ে স্কচটেপগুলো এমনভাবে টেনে তুলল স্পিনোযা যে রানার মনে হলো চামড়া তুলে নেয়া হচ্ছে ওর গাল থেকে।
এবার ওইটাকে… হেনরীর দিকে মাথা ঝাঁকিয়ে ইশারা করল রজার, গায়েব করে দেয়ার ব্যবস্থা করো। কিভাবে কি করতে হবে বলেছি, দেখো, আবার নিজের বুদ্ধি খাটাতে যেয়ো না। আর এটা যেমন আছে থাক এখন। আমি গিয়ে মার্সেলকে পাঠিয়ে দিচ্ছি আধঘণ্টার মধ্যেও এসে ইঞ্জেকশনের। ব্যবস্থা করবে, তারপর দুজন মিলে যেমন যেমন বলেছি, লিখেও দিয়েছি, লিস্ট দেখে একে একে করবে। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ চেয়ে রইল সে রানার দিকে, তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বুদ্ধি ছিল লোকটার, তিনদিনে পাগল করে তুলেছিল আমাদের। কী জীবন! চলন্ত ছায়া যেন! কী যে কার পরিণতি, কেউ বলতে পারে না। চোখ তুলে চাইল স্পিনোর্যর দিকে। চলি, খেয়াল রেখো, কোথাও কোন ভুল না হয়।
ভুল হবে না, স্যার।
লম্বা পা ফেলে দরজার দিকে এগোল ডক্টর রজার। গুনগুন করে সুর ভাজতে ভাজতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। স্পিনোযাও বেরিয়ে গেল ঘর থেকে, ফিরে এল এক মিনিটের মধ্যেই–হাতে ডজনখানেক বড় বড় পেন্ডুলাম। রানার পাশ থেকে একটা তার তুলে নিয়ে ওগুলোর আইলেটের মধ্যে দিয়ে তার ঢুকিয়ে মালা গেঁথে ফেলল একটা। এবার সেই মালাটা হেনরীর কোমরে পরিয়ে দিয়ে ঘাড়ের কাছে কোটটা খামচে ধরে ছেড়ে টেনে নিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। মেঝের উপর হেনরীর জুতো ঘষার শব্দ শুনতে পাচ্ছে রানা। উঠে পড়ল সে, হাতদুটো মুঠো করল বারকয়েক, ভাঁজ করল, তারপর নিঃশব্দ পায়ে এগোল দরজার দিকে।
দরজার কাছে পৌঁছুতেই মার্সিডিজের এঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ এল রানার। কানে। দরজা দিয়ে মাথা বের করে দেখল হেনরীকে মেঝের উপর ফেলে। একটা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে নিচের কাউকে স্যালিউট করছে স্পিনোযা। নিশ্চয়ই ডক্টর রজারকে। ছায়ার মত নিঃশব্দে এগোল রানা।
স্যালিউট সেরে হাসিমুখে পেছন ফিরল স্পিনোযা হেনরীকে তুলে জানালা গলিয়ে নিচের পরিখায় ফেলবার জন্যে। তারপর হঠাৎ আড়ষ্ট হয়ে গেল ওর শরীরটা, মুখ দেখে মনে হচ্ছে জমে পাথর হয়ে গেছে। পাঁচফুটের। মধ্যে পৌঁছে গেছে রানা। ওর মুখের দিকে চেয়ে পরিষ্কার টের পেল রানা, বুঝে গেছে স্পিনোযা–বুঝে গেছে, অন্তিম মুহূর্ত উপস্থিত। তবু শেষ চেষ্টা করল লোকটা। ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গিতে বের করার চেষ্টা করল পিস্তলটা পকেট থেকে। কিন্তু কলজের মধ্যে মৃত্যুভয়ের ছ্যাকা লেগে গেলে ঠাণ্ডা হয়ে আসে হাত-পা, কাজ করতে পারে না ঠিকমত। এক সেকেন্ডের এদিক ওদিকেই নির্ধারিত হয়ে গেল জয়-পরাজয়। পিস্তলটা পকেট থেকে বেরিয়ে এল ঠিকই, কিন্তু সেই মুহূর্তে প্রচণ্ড এক ঘুসি এসে পড়ল ওর সোলার প্লেকসাসে। দাতে দাঁত চেপে চোখ মুখ বানিয়ে বকা হয়ে গেল স্পিনোযা সামনের দিকে। পিস্তলটা ছিনিয়ে নিল রানা প্রায় বিনা বাধাতেই, ধাই করে মারল সে পিস্তলের বাট দিয়ে ওর চোখ আর কানের মাঝখানে রগের উপর। প্রায় একইঞ্চি নিচু হয়ে গেল জায়গাটা, কলকল করে রক্ত বেরিয়ে এল নাক দিয়ে। নিজের অজান্তেই এক পা পিছিয়ে গেল স্পিনোযা। দড়াম করে মারাত্মক লাথি এসে পড়ল ওর তলপেটে। উরুর পেছন দিকটাবাঁধলউইভ-সিলে, স্লো মোশন ছায়াছবির মত ডিগবাজি খেয়ে জানালার বাইরে অদৃশ্য হয়ে গেল স্পিনোযার। শরীরটা। পিস্তল হাতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রানা যতক্ষণ না নিচ থেকে ঝপাৎ শব্দ কানে এল।
জানালা দিয়ে মাথা বের করে নিচের দিকে চাইল রানা। ঢেউ দেখতে পেল সে পরিখার জলে, বাড়ি খাচ্ছে দুপাশের দেয়ালে। ঠিক মাঝখানটায় বুঁদ উঠছে পানির নিচ থেকে। ঘাড় ফিরিয়ে বামদিকে চাইল রানা। দুর্গের খিলানের নিচ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ডক্টর রজারের সাদা মার্সিডিজ।
দ্রুতপায়ে নিচে নেমে এল রানা। বিজ পেরোতে গিয়ে আবার একবার চাইল পরিখার দিকে। বুদ্বুদগুলো ছোট হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছে। সুড়কি বিছানো রাস্তা ধরে দৌড়োতে শুরু করল সে খিলানের দিকে।
.
০৯.
অস্টিনের ড্রাইভিং সীটে উঠে বসে হাতের পিস্তলটার দিকে চাইল রানা। ভুরু নাচিয়ে প্রশ্ন করল নিজেকে, এই নিয়ে কয়বার হাতছাড়া করতে হলো। পিস্তলটা? দেখা যাচ্ছে, যার খুশি সে-ই কেড়ে নিচ্ছে এটা ওর হাত থেকে–যেন ছেলের হাতের মোয়া। যতখানি ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে ওর তাতে, এটাই স্বাভাবিক। আবারও যদি খোয়াতে হয়, এটাকে, অবাক হওয়ার কিছুই নেই। কিন্তু গত দুইবার এটা হারিয়ে যে পরিমাণ পিট্টি আর যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে, সেটার পুনরাবৃত্তি আর চায় না সে। এর একমাত্র সমাধান হচ্ছে, আরও একটা পিস্তল সাথে রাখা।
কাজেই সীটের নিচ থেকে বিট্রিক্সের হ্যাঁন্ডব্যাগটা বের করে আনল রানা। ছোট্ট লিলিপুট পিস্তল, যেটা আত্মরক্ষার জন্যে দিয়েছিল সে বিট্রিক্সকে, যেটা দ্বিধাহীন চিত্তে ব্যবহার করতে পারেনি বলে প্রাণ হারাতে হয়েছে ওকে এবং ওর ভাইকে, সেটা বের করে আনল রানা হ্যাঁন্ডব্যাগ থেকে। সব ঠিক আছে, কিনা দেখে নিয়ে ফুলপ্যান্টের ডান পা-টা উঁচু করল সে কয়েক ইঞ্চি, ব্যারেলটা নিচের দিকে রেখে গুঁজে দিল পিস্তলটা মোজার ভেতর। আরেকটু ঠেসে গোড়ালির পাশ দিয়ে জুতোর ভেতর ঢুকিয়ে দিল সে পিস্তলের নাকটা, তারপর মোজাটা তুলে দিল উপরে।