বারোটা বেজে এবং বাজিয়ে দিয়ে থামল ঘড়িটা। তীব্র যন্ত্রণার একচুল, পরিমাণ উপশম হতেই খানিকটা ঝিমিয়ে নিতে যাচ্ছিল রানা, এমনি সময়ে। আবার মনের ভেতর কথা বলে উঠল কেউ; কই, দেখলে না?
পরিষ্কার বুঝতে পারল রানা, কথা বলছে আর কেউ না, ওর নিজেরই অবচেতন মন। এই মনের কথা জীবনে কখনও উপেক্ষা করেনি সে। খামোকা ভরসা দেবে না এ মন কাউকে। নিশ্চয়ই কিছু একটা ইঙ্গিত দিতে চাইছে। মনটা রানাকে, স্পষ্ট ভাষা জানা নেই বলে স্পষ্ট করে বলতে পারছে না।
আবার ফিরল রানা দেয়ালের দিকে। এইবার চোখে পড়ল ফুটো দুটো। চোখে আগেই পড়েছিল, কিন্তু সচেতন মনে তার কোন ছাপ পড়েনি। কিসের ফুটো? দেয়ালের গায়ে এইরকম ফুটো সষ্টি হওয়ার কি কারণ? চিন্তাশক্তি এতই হ্রাস পেয়েছে রানার যে এই কারণটা বুঝতেই পেরিয়ে গেল ওর, অনেকক্ষণ সময়। ওটা যে কনসীলড ওয়েরিঙের একটা প্লাগ পয়েন্ট, সে কথা। মাথায় এল প্রবল আর এক ঝাঁকুনি খেয়ে দেয়ালের সাথে মাথাটা ঠুকে যেতেই। বহু কষ্টে উঠে বসল রানা।
হাতদুটো পিছমোড়া করে বাঁধা। ইলেকট্রিক কেবলের দুই মাথা খুঁজে পেতেই পেরিয়ে গেল এক যুগ। তারের দুই মাথা আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দেখল। রানা দুদিক থেকেই খানিকটা করে তার বেরিয়ে রয়েছে। আশার আলো জ্বলে উঠল বুকের ভেতর। তারের দুই মাথা সকেটের দুই ফুটোর মধ্যে ঢোকাবার চেষ্টা করছে সে এখন। ম্যালেরিয়া জুরে কাঁপতে কাঁপতে সুইয়ে। সুতো পরাবার চেষ্টা করছে যেন সে সুই বা সুতো কোনটার দিকে না চেয়ে। কিছুতেই ফুটো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দাতে দাঁত চেপে মনোযোগ স্থির রাখবার চেষ্টা করছে সে কিন্তু কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছে না। একবার পেছন ফিরে দেখে নিল, কিন্তু তার ঢোকাবার চেষ্টা করতে গেলেই হারিয়ে যায়। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে, অনুভব করতে পারছে রানা। একটা ফুটোয় তার ঢুকিয়ে দ্বিতীয়টা খুঁজছে এখন সে, সামনের দিকে উদভ্রান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে, কিন্তু চোখে আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না। সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেছে, নীরবে চিৎকার করছে সে যন্ত্রণায়। হাল ছেড়ে দেয়ার ঠিক পরমুহূর্তে ঝাঝাল একটা নীলচে-সাদা আলো দেখতে পেল রানা, তারপর গড়িয়ে পড়ে গেল মেঝেতে।
হয়তো কয়েক সেকেন্ড, কিংবা হয়তো কয়েক মিনিট, ঠিক কতক্ষণ জ্ঞান। হারিয়ে পড়ে ছিল বলতে পারবে না রানা। জ্ঞান যখন ফিরল তখন মনে হলো, ভয়ঙ্কর এক দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম থেকে উঠেছে সে। অপূর্ব শান্তিময় নীরবতা বিরাজ করছে চারপাশে। অখণ্ড নীরবতা নয়, বহুদূর থেকে হালকাভাবে। হট্টগোলের আওয়াজ আসছে ওর কানে। ঢং ঢং করে আরেকটা ঘড়ির ঘন্টা শুরু হতেই সব মনে পড়ে গেল ওর। সকেটের ভেতর একই তারের দুই মাথা, ঢুকিয়ে ফিউজ করে দিয়েছে সে ইলেকট্রিক লাইন, ফলে বন্ধ হয়ে গেই শব্দের নির্যাতন। উঠে বসল রানা দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে। অনুভব করল টপটপ করে রক্ত পড়ছে ওর চিবুক বেয়ে, যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে কখন যে ঠোঁট কামড়ে কেটে ফেলেছে টের পায়নি। ঘেমে নেয়ে উঠেছে সারা শরীর। ক্লান্তিতে ঘুম আসছে দুচোখ ভেঙে।
মিনিট দুয়েক কুকুরের মত জিভ বের করে হাঁপিয়ে বেশ অনেকটা সামলে নিল রানা। তারপর মনে পড়ল ওর, ফিরে আসবে রজার আর স্পিনোযা খানিক বাদেই। এইভাবে ওকে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে থাকতে দেখলে কি ঘটেছে বুঝে নিতে দেরি হবে না ওদের। চট করে চোখ গেল ওর দরজার দিকে। কেউ নেই।
শুয়ে পড়ল সে আবার। গড়াগড়ি শুরু করল মেঝের উপর। আধ-মিনিটের মধ্যেই একজোড়া মাথা দেখতে পেল সে কাঁচের ওপাশে। আর এক ধাপ বাড়িয়ে দিল রানা গড়াগড়ি, মাঝে মাঝে লাফিয়ে হাতখানেক শুন্যে উঠে যাচ্ছে। ওর শরীরটা, যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে গেছে মুখের চেহারা, কখনও টিপে বন্ধ করে রাখছে চোখ, কখনও বড় করে ফেলছে যতটা সম্ভব।
অনাবিল হাসি দেখতে পেল রানা রেভারেন্ড রজারের মুখে। সরল, মধুর হাসি। স্পিনোর্যর দুই চোখ জ্বলছে। দাতে দাঁত চেপে তীব্র দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে সে, হয়তো ভাবছে, রানার যন্ত্রণা আরও কোন উপায়ে বাড়ানো গেলে ভাল হত।
অভিনয় করতে গিয়ে টের পেল রানা, এতেও যথেষ্ট কষ্ট; আসল কষ্টের চেয়ে খুব কম না–কাজেই জোরেসোরে একটা লাফ দিয়ে বাকাচোরা ভঙ্গিতে মেঝের উপর পড়েই স্থির হয়ে গেল।
হাসিমুখে ঘরে ঢুকল রজার। স্পিনোযাকে ইঙ্গিত করতেই ঘড়িগুলো বন্ধ করতে শুরু করল সে। নিজের হাতঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে অ্যামপ্লিফায়ারের। সুইচ অফ করে দিল। বড় বড় ঘড়িগুলো বন্ধ করে দিয়ে রানার পাশে চলে এল। স্পিনো, দড়াম করে একটা লাথি মারল ওর পাজরে। কেঁপে উঠল রানার সর্বশরীর, কিন্তু টু শব্দ না করে মনে মনে ওর বাপ-মা তুলে কয়েকটা গালি দিয়েই সান্তনা খুঁজল রানা।
উঁহুহু! মাথা নাড়ল রজার। ব্যক্তিগত বিদ্বেষ সামলে নিতে হবে তোমার, স্পিনোযা। শরীরে আঘাতের চিহ্ন থাকলে চলবে না। ব্যাপারটা পছন্দ করবে না পুলিস।
দাগ তো পাওয়া যাবেই, স্যার। ওর মুখটা দেখুন না। প্রতিবাদ করল স্পিনোযা।
ওগুলো দুপুরের দাগ। পুরানো। নতুন দাগ আর চাই না। হাত-পায়ের বাধন খুলে দাও, এসব চিহ্নও রয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। হেডফোনটা খুলে নিয়ে প্লাস্টারগুলো আবার সাটিয়ে দাও জায়গামত।