পাগলের মত গড়াগড়ি খাচ্ছে রানা মেঝের উপর। কিন্তু টান করে বাঁধা রয়েছে হাতদুটো কড়ার সাথে, বেশিদূর গড়াতেও পারছে না। বড়শিতে গাঁথা। চিতল মাছের মত যন্ত্রণায় একেবেকে ছটফট করছে সে, নিজের অজান্তেই লাফিয়ে উঠছে শরীরটা আধহাত, কখনও খটাশ করে বাড়ি খাচ্ছে মাথাটা দেয়ালের সাথে–কোনদিক থেকে কোনদিকে গড়াচ্ছে কোন হুশ নেই। এরই ফাঁকে চোখ গেল একবার দরজার দিকে। কাঠের দরজা, উপরটায় কাঁচ বসানো। কাঁচের ওপাশে দেখতে পেল সে ডক্টর রজার আর স্পিনোযাকে। চকচকে কৌতূহলী চোখ মেলে চেয়ে রয়েছে ওর দিকে। ঘড়িটা চোখের কাছে। তুলল স্পিনোর্য, কিছু বলল, মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিয়ে রানার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে রওনা হয়ে গেল রজার অনিচ্ছাসত্ত্বেও। রানা বুঝতে পারল, যত শিগগির সব কাজ সেরে ফিরে আসবার চেষ্টা করবে ওই সাইকোপ্যাথ।
পনেরো মিনিটে মাথা খারাপ হয়ে যাবে, বলেছে রজার। কিন্তু রানার বিশ্বাস হচ্ছে না কথাটা। এই অবস্থায় তিন মিনিটের বেশি কি করে কারও পক্ষে মাথা ঠিক রাখা সম্ভব, বোঝা মুশকিল। এপাশ-ওপাশ মাথা ঠুকল রানা। ভেঙে ফেলবার চেষ্টা করছে এয়ারফোন। সরবো-রাবার মোড়া এয়ারফোন যে সত্যিকার অর্থেই আনব্রেকেবল হাড়ে হাড়ে টের পেল সে। মেঝের সাথে কান ঘষে খসিয়ে ফেলবার চেষ্টা করল সে এয়ারফোনটা, পারল না। নিজের অজান্তেই যন্ত্রণা থেকে বাচবার স্বাভাবিক শারীরিক তাগিদে এসব করছে, সে, খেয়ালই করল না যে ঘষাঘষিতে মুখের প্লাস্টারগুলো খসে গিয়ে দরদর করে। আবার নেমেছে রক্তের ধারা।
টিক টিক টিক টিক, ঢং ঢং ঢং ঢং, বিরামহীন বেজে চলেছে ঘড়িগুলো, একটা ঘণ্টা বন্ধ হওয়ার দশ পনেরো সেকেন্ডের মধ্যে শুরু হয়ে যায়। আরেকটার ঘটা। অসহ্য! এক মুহূর্তও স্বস্তির ব্যবস্থা নেই। সায়ুগুলোকে তীক্ষ্ণ চিরুনি দিয়ে আচড়াচ্ছে যেন কেউ। দেহের একেকটা অংশ এপিলেপটিক কনভালশনের মত আলাদাভাবে লাফাচ্ছে তড়াক তড়াক। পাগলা গারদে রোগীর উপর ইলেকট্রিক শক প্রয়োগ করলে কারও কারও হাড়গোড় ভেঙে যায় কেন বুঝতে পারল রানা। এই প্রচণ্ড শব্দের আক্রমণ ইলেকট্রিক শকের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে অনেক বেশি, কিন্তু অঙ্গহানির পক্ষে যথেষ্ট নয়।
কতক্ষণ সময় পেরিয়ে গেছে বুঝতে পারল না রানা। এই অবস্থায় সময়ের হিসেব রাখা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। হঠাৎ একসময় পরিষ্কার বুঝতে পারল, অন্ধকারে কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে সে! ঘোলা হয়ে আসছে ওর কাছে সবকিছু। হোক, ভাবল রানা। যদি সমস্ত বোধশক্তি হারিয়ে যায়, এই যন্ত্রণার চেয়ে সেটা বরং অনেক ভাল। চরম পরাজয় হয়েছে এবার ওর, হেরে গেছে সে। এ পর্যন্ত যে-ই ওঁর সংস্পর্শে এসেছে, সে-ই মারা পড়েছে। যেখানেই গিয়েছে, দুষ্টগ্রহের মত অশুভ ছায়া ফেলেছে সে। মারিয়া শেষ, ইসমাইল শেষ, বিট্রিক্স শেষ, ওর ভাই হেনরী শেষ–আজ সন্ধেয় শেষ হয়ে যাবে সোহানাও। যাক সব শেষ হয়ে যাক, সেইসাথে সে নিজেও। শেষ হয়ে যাক একটা অশুভ পরিচ্ছেদ।
হঠাৎ মনে হলো, সোহানা আশা করবে ওকে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আশা করবে, ওর স্বপ্নের রাজকুমার মাসুদ রানা যেমন করেই তোক রক্ষা ওকে, করবেই। শুধু আশা নয়, বিশ্বাস করবে সোহান-মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও রানার। প্রতি ওর অটল বিশ্বাস নড়বে না একচুল। গলায় ফাস পরেও ভাববে, আর দেরি নেই, এই রানা পৌঁছুল বলে। কিন্তু আসলে পৌঁছুতে পারবে না রানা। নিজেই শেষ হয়ে বসে আছে সে।
হঠাৎ একজোড়া কাঁচাপাকা ভুরু দেখতে পেল রানা। তীক্ষ্ণ একজোড়া চোখ। চোখের দৃষ্টিতে ভর্ৎসনা। যেন বলছে রানাকে তোমাকে কি শিক্ষা দিয়েছি আমি রানা? বলেছি না, ভেঙে যাবে, কিন্তু কিছুতেই বাকবে না? সাবধান! বাকা হয়ে যাচ্ছ তুমি, রানা। তোমার হাতে সঁপে দিয়েছি আমি সোহানাকে। যেমন করে পারো বাঁচাও ওকে। হাল ছেড়ো না। চারপাশে চেয়ে দেখো, উপায় আছেই কিছু না কিছু। সব সমস্যারই সমাধান আছে।
দাঁতে দাঁত চেপে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল রানা। না, স্যার। কোনও উপায় নেই, আমি পারলাম না। যদি পারেন, ক্ষমা করে দেবেন।
কোমল হয়ে এল বৃদ্ধের কঠোর দৃষ্টি। রানা!.তোমাকে হারাতে খুব খারাপ লাগবে আমার। খুবই কষ্ট হবে। বুড়ো মানুষটাকে এত দুঃখ দেবে? চারপাশটায় একটু দেখোই না চেয়ে, নিশ্চয়ই উপায় আছে কিছু। তোমার। নাগালের মধ্যেই।
ঝট করে দেয়ালের দিকে ফিরল রানা ঘোর কাটিয়ে উঠে। মৃগী রোগীর মত থরথর করে কাঁপছে ওর সারা শরীর, লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে হাত-পা আপনাআপনি স্নায়বিক ঝাঁকুনি খেয়ে। দুই এক সেকেন্ডের বেশি কোনদিকে স্থির থাকতে চাইছে না চোখের দৃষ্টি।, তবু চাইল এদিক ওদিক কিছুই চোখে। পড়ল না ওর। কোন উপায় নেই কোনদিকে। এমনি সময়ে কোনরকম। প্রস্তুতির সুযোগ না দিয়েই হঠাৎ তীব্রতম হয়ে উঠল মাথার ভেতর শব্দের যন্ত্রণা। মস্ত একটা ঘড়ি প্রচণ্ড শব্দে সময়-সঙ্কেত দিতে শুরু করেছে। কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে উঁচু হয়েছিল, দড়াম করে আছড়ে পড়ল রানা। আবার মনে হলো, মস্ত এক মুগুর দিয়ে পিটাচ্ছে কেউ ওর কানের উপর। একেকটা ঘণ্টার শব্দে লাফিয়ে আধহাত শূন্যে উঠে যাচ্ছে ওর শরীরটা।