মৃতদেহটার কাছে রানাকে ঠেলে নিয়ে গেল স্পিনোযা। হাতদুটো পিছমোড়া করে বেধে ফেলা হলো মোটা ইলেকট্রিক তার দিয়ে, পা দুটোও বাধা হলো জোড়া করে, তারপর দেয়ালের একটা আংটার সাথে শক্ত বাধা চারফুট লম্বা একটা তারের মাথার সাথে এটে দেয়া হলো রানার হাতের কব্জি।
চালু করো ঘড়িগুলো। হুকুম দিল ডক্টর রজার।
দ্রুতহাতে একের পর এক ঢাকনি খুলে পেন্ডুলামগুলো দুলিয়ে দিতে শুরু করল স্পিনোযা। ছোটবড় নানান রকম।
আপনাকে আগেই বলেছি, অচল ঘড়ি একটাও নেই এখানে–সব সচল। সবটাতেই ঘণ্টা বাজে। পিস্তলটা পকেটে রেখে কাছে এগিয়ে এল ডক্টর রজার। সামলে নিয়ে আবার হাসি-খুশি ভাবটা ফিরিয়ে এনেছে সে নিজের মধ্যে। এয়ারফোনের মাধ্যমে দশগুণ বেড়ে যাবে ঘড়ির আওয়াজ। ঠিক দশগুণ বেশিও না, কমও না–একেবারে হিসেব করা। ওই যে দেখুন অ্যামপ্লিফায়ার, আর ওই যে মাইক্রোফোন। দুটোই আপনার নাগালের বাইরে। এয়ারফোনটা আনরেকেবল। হাজার চেষ্টা করলেও খসাতে পারবেন না ওটা কান থেকে। ঠিক পনেরো মিনিটের মধ্যে পাগল হয়ে যাবেন আপনি, বিশ মিনিটের মধ্যে জ্ঞান হারাবেন। জ্ঞান ফিরে আসবে আট থেকে দশ ঘণ্টা পরবদ্ধ উন্মাদ অবস্থায়। কিন্তু সে নিয়ে ভাবতে হবে না আপনার, জ্ঞান আর ফিরে আসবে না আপনার কোনদিনই। চারপাশে চাইল রজার। অর্ধেক বাকি আছে চাল হতে এরই মধ্যে কেমন হাটবাজার বসে গেছে দেখেছেন?
এইভাবেই নিশ্চয় খুন করা হয়েছে হেনরীকে? বাইরে থেকে দেখবেন আপনারা, ওই দরজার কাঁচের ওপাশ থেকে। মানুষের যন্ত্রণা দেখতে ভাল লাগে আপনার?
খুব ভাল লাগে। কিন্তু দুঃখের বিষয় আপনার কষ্ট সবটা দেখবার সুযোগ। হবে না আমাদের। কিছু জরুরী কাজ পড়ে রয়েছে আমাদের। অবশ্য যত তাড়াতাড়ি পারি সেগুলো সেরে ফিরে আসবার চেষ্টা করব আমরা। বিশেষ করে প্রথম আর শেষটুকু সত্যিই দেখবার মত হয়। এ
একের পর এক দোলক দুলিয়ে চলেছে স্পিনোর্য। মুহুর্মুহু ঘণ্টা পড়ছে, একটা থামে তো শুরু করে আর একটা কোনটায় পড়ছে দুটো ঘণ্টা, কোনটায় নয়টা, কোনটায় একটা, কোনটায় বারোটা। কোনটা হালকা সুরে, কোনটা গভীর, কোনটা উঁচু পর্দায়, কোনটা আবার খুবই খাদে।
আমার লাশ গায়েব করে ফেলে আপনি মনে করেছেন…
আহা, গায়েব করতে যাব কেন? বাধা দিয়ে পাকা মাথাটা দোলাল ডক্টর রজার। কাল রাতে বার্জ-বন্দরে চেয়েছিলাম সেটা। কিন্তু সেটা ছিল তাড়াহুড়োর সিদ্ধান্ত। এখন অনেক ভাল প্ল্যান এসেছে আমার মাথায়। গায়েব করব তো না-ই, ডুবে যাওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই উদ্ধার করা হবে আপনার লাশ।
ডুবে যাওয়ার মানে?
মানে, জ্ঞান হারাবার পর আপনার হাতের ওপর কিছু কারুকাজ করা হবে যাতে মনে হয় হাত পাকিয়ে ফেলেছেন আপনি ইঞ্জেকশন নিয়ে নিয়ে। একডোজ হেরোইনও ঢুকিয়ে দেয়া হবে আপনার শরীরে। তারপর গাড়ির ড্রাইভিং সীটে বসিয়ে গাড়িসুদ্ধ আপনাকে ঠেলে ফেলে দেয়া হবে শহরের কোন খালে। এবং সাথে সাথেই ফোন করা হবে পুলিসে। ঘড়ির গোলমালে প্রায় চিৎকার করে কথা বলতে হচ্ছে এখন ওকে। অটপসি হবেই। আপনার হাতে হাইপোডার্মিকের পাংচার দেখে চমকে যাবে সবাই। আরও ইনভেস্টিগেশন করে দেখা যাবে হেরোইন পাওয়া যাচ্ছে। স্বভাবতঃই পুলিস। বিশ্বাস করতে চাইবে না ব্যাপারটা। মাসুদ রানা, ইন্টারপোলের ইনভেস্টিগেটর…সে কি পুশার হতে পারে? অসম্ভব। আপনার মাল পত্র সার্চ করে দেখা হবে। কেচো খুড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে পড়বে তখন। এমন কিছু কাগজপত্র পাওয়া যাবে আপনার সুটকেসের গোপন কম্পার্টমেন্টে, যাতে কারও কোন সন্দেহ থাকবে না যে আসলে ড্রাগ রিঙ ধ্বংস করতে আসেননি আপনি অ্যামস্টার্ডামে, এসেছেন তাদের সাথে একটা গোপন চুক্তিতে পৌঁছুতে। বেশ কিছু হেরোইন পাওয়া যাবে আপনার সুটকেসে, আপনার পকেটে পাওয়া যাবে ক্যানাবিসের শুখা। আহা! বড়ই দুঃখজনক! কে ভাবতে পেরেছিল এমন একজন লোক আসলে এই? গাছেরটাও খাচ্ছে, তলেরটাও কুড়োচ্ছে।
গোটাকয়েক গালি দিল রানা। কিন্তু ঘড়িগুলোর প্রচণ্ড গোলমালে বোধহয়। শুনতে পেল না ডক্টর রজার। একগাল হেসে রানার মাথার উপর দিয়ে। এয়ারফোনটা পরিয়ে দিল সে ওর দুই কানে, তারপর একটা অ্যাডহেসিভ টেপের প্রায় অর্ধেক রীল খরচ করে এমনভাবে আটকে দিল ওটাকে, যেন কিছুতেই না খোলে। এয়ারফোনটা কানে পরিয়ে দিতেই ঘড়ির গোলমাল অনেকটা কমে গেল, মনে হচ্ছে বহুদূর থেকে ভেসে আসছে হৈ-হল্লার শব্দ। অ্যামপ্লিফায়ারের কাছে চলে গেল এবার ডক্টর রজার, রানার দিকে চেয়ে মিষ্টি হেসে টিপে দিল সুইচ।
ঠিক যেন ইলেকট্রিক শক খেয়েছে, এমনি প্রচণ্ডভাবে চমকে উঠল রানা। শব্দ দিয়ে মানুষকে এত ভয়ঙ্কর নির্যাতন করা যায় কল্পনাও করতে পারেনি সে। মুহূর্তে সামনের দিকে বাকা হয়ে গেল ওর শরীরটা, হুড়মুড় করে পড়ে গেল মেঝের উপর, পড়েই কাটা মুরগীর মত লাফাতে শুরু করল। প্রচণ্ড শব্দ! দাতে দাঁত চেপে সহ্য করবার চেষ্টা করছে সে। মনে হচ্ছে গরম শিক ঢুকিয়ে দিয়েছে কেউ ওর কানের ভেতর, খোঁচাচ্ছে মগজের মধ্যে। কানের পর্দা ফেটে যাচ্ছে না কেন বুঝতে পারল না রানা, পর্দা ফেটে গেলে নিষ্কৃতি পাওয়া যেত এই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে। কিন্তু ফাটছে না। রানা বুঝতে পারল, এমনভাবে মাপ বেধে দেয়া হয়েছে যেন কানের পর্দা ফেটে গিয়ে কেউ রেহাই পায় না।