একনজরেই বোঝা যাচ্ছে, এটা প্রদর্শনী ঘর। ঘরের চার দেয়ালেই টাঙানো রয়েছে আশ্চর্য সুন্দর কয়েকশো দামী ঘড়ি। প্রত্যেকটা দেয়াল মেঝে থেকে কোমরসমান উঁচু পর্যন্ত সবুজ-সাদা মোজাইক করা, সেখান থেকে ৩ ছয়ফুট চওড়া পালিশ করা কাঠ, তার উপর থেকে সিলিং পর্যন্ত আবার। মোজাইক চার দেয়াল জুড়ে ছয়ফুট চওড়া কাঠের প্যানেলের উপর অপূর্ব। সুন্দর করে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন ডিজাইনের, বিভিন্ন আকৃতির দেয়ালঘড়ি কোনটা পাঁচফুট বাই তিন ফুট, কোনটা পাঁচইঞ্চি বাই তিনইঞ্চি। ঘড়ির কারুকাজের বাহার হাঁ করে চেয়ে থাকবার মত।
সবগুলো ঘড়ি মিলে কত দাম হবে আন্দাজ করবার চেষ্টা করল রানা, পারল না। লক্ষ করল প্রত্যেকটাই পেন্ডুলাম কুক। মাত্র কয়েকটা ঘড়ি চলছে। সবকটা ঘড়ি যদি একসাথে চলতে শুরু করে তাহলে কি বিকট আর ভয়ঙ্কর শব্দ হবে ভেবে গালদুটো একটু কুঁচকে উঠল রানার। আট-দশটা চলছে, তাতেই বিরক্ত হয়ে উঠল সে দশ সেকেন্ডের মধ্যে। এই ঘরে বসে দশ মিনিটও কোন মনোযোগের কাজ করতে পারবে না সে-ছুটে পালাতে হবে।
অপূর্ব কালেকশন…কি বলেন? আত্মতৃপ্তির হাসি হাসল ডক্টর রজার। সারা দুনিয়ায় এর জুড়ি পাবেন কিনা সন্দেহ। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখতে পাবেন বরং বলা উচিত, শুনতে পাবেন–এগুলো প্রত্যেকটাই চলে। অচল। ঘড়ি এখানে একটাও নেই।
কথাগুলো শুনল রানা, কিন্তু বক্তব্যটা ঠিক অনুধাবন করতে পারল না। ভুরুজোড়া কুঁচকে উঠেছে ওর। স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে সে ঘরের। এককোণে উপুড় হয়ে পড়ে থাকা লোকটার দিকে। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা চুল, পিঠের হাড় দেখা যাচ্ছে কোটের উপর দিয়েও। দুপা এগিয়ে চমকে উঠল। রানা লোকটার মুখের দিকে চেয়ে। বীভৎস! ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছিল। মুখটা মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে–সেই রকমই রয়ে গেছে। হেনরী শেরম্যান। একনজরেই বোঝা গেল-মৃত! পাশেই পড়ে আছে কয়েক টুকরো সিঙ্গেল কোর রাবার-ইনসুলেটেড বৈদ্যুতিক তার। মাথার পাশে মেঝের উপর পড়ে আছে একটা রাবার মোড়া এয়ারফোন।
অ্যাকসিডেন্ট, দুঃখিত কণ্ঠে বলল রজার! ভাবতেও পারিনি এত অল্পেই পটল তুলবে ছেঁড়া। এতটা যে কাহিল হয়ে পড়েছিল, কল্পনাও করতে পারিনি।
ওকে খুন করেছেন কেন? রজারের দিকে ফিরল রানা। খুন? তা অবশ্য এক হিসেবে খুনই বলা যায় একে।
কেন?
ওর বোনটা যখন আমার ওপর আর ভরসা রাখতে পারল না, ভিড়ে গেল আপনার দলে, তখন এছাড়া আর কি উপায় ছিল ওকে শাস্তি দেয়ার? গত তিনটে বছর ধরে ওকে দিয়ে যা খুশি করিয়েছি আমরা। ওকে ধারণা দেয়া হয়েছিল যে ওর ভাইকে খুনের দায়ে খুঁজছে পুলিস, আমাদের হাতে তথ্য প্রমাণ রয়েছে, যে কোন সময়ে তুলে দিতে পারি পুলিসের হাতে। এই ভাইয়ের মায়া কাটাতে পারেনি বলেই মনের বিরুদ্ধে অনেক কাজ করতে হয়েছে মেয়েটাকে। কাজেই, স্বাভাবিকভাবেই, ওকে শাস্তি দেয়ার প্রয়োজন যখন দেখা দিল, ওর দুর্বলতম জায়গায় অর্থাৎ, এই ভাইটির ওপরই নির্যাতন চালাতে হলো আমাদের। ওর সামনে। তবে একটা কথা আপনার জানা থাকা ভাল, হেনরী বা তার বোনের মৃত্যুর ব্যাপারে আমি যতটা না দায়ী, তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী আপনি নিজে। শুধু এরাই নয়, আপনার সহকারিণী মারিয়া ডুকজের মৃত্যুর জন্যেও আমি দায়ী করব আপনাকেই। কথাটা বলতে। বলতে ঝট করে দুই পা পিছিয়ে গিয়ে পিস্তলটা রানার চোখের দিকে লক্ষ্য করে ধরল রজার। ঝাঁপ দিলেই মারা পড়বেন, মিস্টার মাসুদ রানা। আমি বুঝতে পারছি, খড়-নত্য, আপনি একটুও উপভোগ করতে পারেননি। মারিয়ার কাছেও নিশ্চয়ই ভাল লাগেনি আমার ফাইন আর্ট। এবং আমার বিশ্বাস, আজ সন্ধ্যায়। সোহানা চৌধুরীর কাছেও খুব একটা ভাল লাগবে না। তাকেও ওপারের টিকেট কাটতে হচ্ছে আজই সন্ধ্যায়। বাহ! বেশ গভীরে গিয়ে লাগছে মনে হচ্ছে কথাগুলো! গুম! আমাকে হত্যা করার ইচ্ছে হচ্ছে আপনার মধ্যে, মিস্টার মাসুদ রানা। হাসি লেগে রয়েছে রজারের ঠোঁটের কোণে, কিন্তু নিষ্পলক ভাবলেশহীন চোখদুটোর দিকে চেয়ে মনে হচ্ছে উন্মাদের চোখ।
হ্যাঁ। খুবই ইচ্ছে হচ্ছে। সুযোগ পাওয়ামাত্র করব। সহজ কণ্ঠে বলল রানা।
আমি দুঃখিত। এ জন্মে আর সুযোগ পাচ্ছেন না। নেক্সট টাইম, কি বলেন? যাই হোক, যা বলছিলাম, একটা ছোট্ট চিরকুট পাঠিয়ে দিয়েছি আমরা। সোহানা চৌধুরীর কাছে। চোখ টিপল রজার। কি যেন ছিল কোড ওয়ার্ডটা? ও হ্যাঁ, মাদাগাস্কার। ওকে লেখা হয়েছে, ভলেনহোভেন কোম্পানীতে দেখা করতে হবে আপনার সাথে, আজই সন্ধ্যায়। বিচিত্র কর্কশ আওয়াজ করে। হাসল রজার। ভলেনহোভেনকে আর কেউ সন্দেহ করতে পারবে না। একই ওয়েরহাউজে পরপর দুটো খুন হতে দেখলে কে ভাবতে পারবে ওয়েরহাউজের মালিকের হাত রয়েছে এতে? নিজের বাড়িতে কেউ করে এই কাজ? একটা। ফাইন টাচেই সন্দেহের ঊর্ধ্বে চলে যাচ্ছে ভলেনহোভেন। আবার একটা লাশ ঝুলতে দেখা যাবে কাল সকালে হয়েস্টিং বীমের সাথে; দুলবে বাতাসে।
আপনি জানেন যে আপনি একটা বদ্ধ উন্মাদ? জিজ্ঞেস করল রানা।
বাঁধো ওকে, রানার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কর্কশ কণ্ঠে আদেশ করল সে স্পিনোযাকে। মুহূর্তের জন্যে ভদ্রতার মুখোশ খসে যেতে দেখে বুঝতে পারল রানা, কথাটা ওর কোন দুর্বল জায়গায় গিয়ে লেগেছে।