এগুলো নিশ্চয়ই স্যামুয়েলের হাতের ছাপ? পিস্তলের মাথা দিয়ে মৃদু দুটো টোকা দিল স্পিনোযা রানার চোয়ালে আঁটা প্লাস্টারের উপর, তারপর ফোর-সাইটটা চেপে ধরে চড়চড় করে তুলে ফেলল একটা প্লাস্টার। ভয়ঙ্কর। একটুকরো হাসি ওর ঠোঁটে। সহজ গলায় জিজ্ঞেস করল, কি? ব্যথা লাগছে খুব?
আহা, স্পিনোযা, আবেগপ্রবণ হয়ো না। আগেই বলেছি তোমাকে, সামলে রাখতে হবে নিজেকে। মনের মধ্যে আক্রোশ এসে গেলেই বুঝবে। ঘোলা হয়ে গেছে বুদ্ধিটা। কয়েক পা পিছিয়ে গেল রজার। এবার পিস্তলটা ওর বুকের দিকে তাক করে ধরো দেখি। স্পিনোযা রানার পিস্তলটা পরীক্ষা। করে দেখে নিয়ে তাক করে ধরল নিজেরটা পকেটে ফেলে মুখ বাঁকা করল রজার। এসব জিনিস আমার মোটেই পছন্দ হয় না, মিস্টার মাসুদ রানা। স্কুল, অমার্জিত, গোলমেলে জিনিস-সৌন্দর্য বা শিল্পমাধুর্যের কিছু…
গলায় রশি বেঁধে হয়েস্টিং বীমের সাথে ঝুলিয়ে দেয়া, বা হে-ফর্কের। খোঁচায় খোঁচায় হত্যা করার মধ্যে আছে? নরম গলায় জানতে চাইল রানা।
এই দেখুন, আপনি আবার আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছেন, একগাল হাসল রেভারেন্ড রজার। যে-কোন শিল্প-সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে, অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করবার ক্ষমতা অর্জন করে নিতে হয়। এজন্যে প্রস্তুতি দরকার, নিজেকে শিক্ষিত করে নেয়া দরকার। চট করে একদিনে কেউ ক্লাসিক্যাল মিউজিকের ভক্ত হয়ে যায় না। আপনার যদি ভাল না লাগে, দোষটা আপনার, ক্লাসিক্যাল মিউজিক বা পিকাসোর পেইন্টিঙের না! এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ল ডক্টর রজার দুঃখিত ভঙ্গিতে। আপনি নিরাশ করেছেন আমাকে। সত্যি। বলতে কি, আপনার এত নাম শুনেছি যে চমৎকার খেলা জমবে মনে করে। রীতিমত আনন্দিত হয়ে উঠেছিলাম আমি আপনার আগমন সংবাদে। অনেক আশা করেছিলাম আমি আপনার কাছে। কিন্তু কি দেখলাম? ভুলের পর ভুল করলেন আপনি এখানে, ওখানে, সেখানে নির্বোধের মত পা দিলেন একের পর এক পেতে রাখা ফাঁদে। যখন আমি তীক্ষ্ণবুদ্ধির কোন প্যাঁচ আশা করছি, প্রমাণ পাচ্ছি আকাট নির্বুদ্ধিতার! কি জন্যে যে আপনাকে পৃথিবীর সেরা স্পাই বলা হয় কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলাম না আমি আজ পর্যন্ত। প্রতিটা পদক্ষেপেই ভুল করছেন আপনি। মূর্খের মত কিছু কাজ করে মনে মনে ভাবছেন, ঢিল লাগিয়ে দিয়েছেন ভীমরুলের চাকে, রাগে অন্ধ হয়ে কিছু ভুল। করে বলব আমরা। আবার মাথা নাড়ল এপাশ-ওপাশ। নাহ! বড়ই নিরাশ হয়েছি। আপনারই দোষে প্রাণ দিতে হয়েছে বিট্রিক্স শেরম্যানকে। কোনরকম সতর্কতা অবলম্বন না করেই আপনি দুই দুইবার গিয়েছেন ওর ঘরে, আপনাদের কথাবার্তা রেকর্ড হচ্ছে কিনা সে সম্পর্কে কোন সন্দেহই জাগেনি আপনার সরল অন্তরে। আপনার সবকিছুতেই ভুল। কোনটা ছেড়ে কোটা বলি? ফ্লোর ওয়েটারের পকেট হাতড়ে যে কাগজটা পাবেন বলে আশা। করেছিলাম, সেটাই পেলেন আপনি–যদিও ওটা আদায় করতে গিয়ে বেচারীকে খুন করবার কোন যৌক্তিকতা দেখি না আমি। পরিষ্কার দিনের আলোয় হেঁটে বেড়াচ্ছেন আপনি হাইলারে, ভাবতেও পারছেন না, ওখানকার। অধেকের বেশি লোক আমার অনুগত, আপনার জীবিত থাকার খবর আমি পেয়ে যাব সাথে সাথেই। চার্চের বেজমেনে আপনার ভিজিটিং কার্ড রেখে আসছেন আপনি, তাজা রক্ত পাওয়া যাচ্ছে মেঝের উপর, অথচ ভাবছেন, কাকপক্ষীও টের পাচ্ছে না কিছু। ওই লোকটাকে খুন করায় অবশ্য কোন রাগ নেই আমার আপনার ওপর। আপনি ওর ব্যবস্থা না করলে আমার নিজেরই করতে হত–মাথার বোঝা হয়ে উঠেছিল লোকটা ক্রমে। যাই হোক, এ কয়দিন দেখে-শুনে আমাদের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে আপনার কি ধারণা হলো। শোনা যাক। কি মনে করেন, ফাঁক পেয়েছেন কোথাও?
আপনাদের তিনটে ব্যবসাতেই ফাঁক রয়েছে। বাইবেল, হাইলারের। পুতুল আর দেয়ালঘড়ির পেন্ডুলাম–প্রত্যেকটাতেই ফাঁক দেখতে পেয়েছি। চার্চের নিচতলায় যে বিশেষ আকৃতির দোলক তৈরি করা হয় সেটা বুঝতে খুব। বেশি বেগ পেতে হয়নি আমার।
কিন্তু এত বুঝেও ঠেকাতে পারলেন না আমাদের, পবিত্র হাসি রেভারেন্ডের মুখে। ঠিকই ধরেছেন, ফাপা দোলকের মধ্যে পুরে দিচ্ছি আমরা। এক বিশেষ ধরনের পাউডার। বাক্সে পোরা হচ্ছে দেয়াল ঘড়িগুলো, কাস্টম ইন্সপেকশন হচ্ছে, তারপর সীল করে সরকারী দফতরের অনুমোদনপত্রসহ পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় আমাদের বিশেষভাবে নির্বাচিত ডিলারদের কাছে। এতই নিখুঁত, এতই…
খুক খুক কুরে গলা পরিষ্কার করল স্পিনোর্য। মিস্টার রজার আপনি বলছিলেন বিশেষ জরুরী এক কাজে…।
ঠিক বলেছ। অযথা বাজে কথায় দেরি করা ঠিক হচ্ছে না। মিস্টার স্পাইয়ের একটা ব্যবস্থা করেই ছুটতে হবে আমাকে আবার, …চট করে। একপাক ঘরে দেখে এসো তো অল ক্লিয়ার কিনা।
বিতৃষ্ণার সাথে আবার পিস্তলটা বের করল রজার, নিঃশব্দ দ্রুতপায়ে চারপাশের কয়েকটা জানালায় চোখ রেখে ফিরে এল স্পিনোযা, মাথাটা কাত করল ডানপাশে। পিস্তলের মুখে একতলা দালান থেকে বের করে দুর্গের সদর দরজার কাছে নিয়ে আসা হলো রানাকে। বড়সড় একটা চাবি ঢুকিয়ে যোচড় দিতেই ওক কাঠের বিশাল দরজা খুলে হাঁ হয়ে গেল। প্রশস্ত সিঁড়ি বেয়ে। দোতলায় উঠে প্যাসেজ ধরে কিছুদূর এগিয়ে আর একটা মস্ত ঘড়ি ঘরে ঢোকানো হলো রানাকে।