বুক সমান উঁচু ঘাসের আড়ালে আড়ালে অতি সন্তপণে একতলা দালানের একপাশে সরে এল রানা, তিন লাফে ফাঁকা জায়গাটুকু পেরিয়ে সেটে দাঁড়াল। দেয়ালের গায়ে। দুই মিনিট চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে কোনদিক থেকে কারও কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে পা টিপে এসে দাঁড়াল একটা জানালার সামনে। সাবধানে মাথা তুলে উঁকি দিল পর্দার ফাঁক দিয়ে।
ভেতরে শুধু ঘড়ি আর ঘড়ি। প্রকাণ্ড ঘরটা একযোগে ঘড়ির কারখানা এবং স্টোর। তিন পাশের দেয়াল জুড়ে মেঝে থেকে ছাত পর্যন্ত টাঙানো রয়েছে। ছোটবড় নানান ডিজাইন ও আকৃতির দেয়ালঘড়ি। বড়সড় চারটে ওয়ার্ক টেবিলের উপরও অনেকগুলো করে ঘড়ি আর তার ভেতরের যন্ত্রপাতি কলকজা। একপাশে মেঝের উপর গোটা দশেক বাক্স দেখা গেল, খোলা। মার্সিডিজে করে ঠিক যে রকম বাক্স আনা হয়েছে, সেই রকম। সব দেয়াল ভর্তি হয়ে যাওয়ায় ঘরের একপাশে আড়াআড়ি করে গোটাকয়েক শেলফ রাখতে হয়েছে। প্রত্যেকটা তাক ভর্তি হয়ে যাওয়ায় কয়েকশো ঘড়ি রাখতে হয়েছে মেঝের উপর।
রজার এবং সেই শুকনো-পাতলা লোকটা ব্যস্ত রয়েছে একটা শেলফের কাছে। রজারের হাতে এক টুকরো কাগজ, লোকটার হাতে গোটা দশেক পেন্ডুলাম-নম্বর মিলিয়ে মিলিয়ে একেকটা ঘড়ির মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে সেগুলো। নিচু হয়ে ঝুঁকে আবার গোটাকয়েক পেন্ডুলাম তুলে নিল লোকটা একটা বাক্স থেকে। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে বলে মনে হলো রানার। মাথা নাড়ছে রজার, ডান হাতের তর্জনী দিয়ে কাগজের একটা জায়গায় খোঁচা দিল, নিচু গলায় কিছু বলল পাশের লোকটাকে। ঘাড় বাঁকিয়ে কাগজের দিকে চাইল লোকটা, তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে নিজের কাজে মন দিল। কাগজের উপর থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই একটা সাইড ডোর দিয়ে বেরিয়ে গেল ডক্টর রজার, অদৃশ্য হয়ে গেল রানার দৃষ্টিপথ থেকে। ইসমাইলের হত্যাকারী পকেট থেকে আরেকটা কাগজ বের করে একই আকারের দুটো করে পেণ্ডুলাম। সাজাতে শুরু করল একটা টেবিলের উপর।
রজার ব্যাটা গেল কই?-ডাবল রানা। সাথে সাথেই উত্তর পেয়ে গেল সে। ঠিক পেছন থেকে।
আমাকে নিরাশ করেননি দেখে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, মিস্টার। রানা।
ধীরে ধীরে পেছন ফিরল রানা। সাধুপুরুষের নিষ্পাপ হাসি মুখে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে রেভারেন্ড রজার, হাতে একটা বড় আকাবের বেমানান পিস্তল, পিস্তলের মুখটা সোজা রানার হৃৎপিণ্ডের দিকে ধরা।
বিড়ালকেও হার মানিয়ে দিয়েছেন আপনি, মিস্টার রীনা! আনন্দ বিগলিত কণ্ঠে বলল রজার। আপনাকে বোধ হয় একটু আন্ডারএস্টিমেটই করে ফেলেছিলাম আমি। গত তেরো ঘণ্টার মধ্যে দুই দুইবার আপনার মৃত্যুর ব্যবস্থা করেছি। আমি নিশ্চিন্ত হয়েছি আপনার অবধারিত মৃত্যু সম্পর্কে, কিন্তু বড় শক্ত জান আপনার, ঠিক কোন না কোন ফাঁক গলে বেরিয়ে পড়েছেন, আমার জাল থেকে। আমার জন্যে এটা অত্যন্ত অবমাননার কথা। জীবনে এমন ঘোল কেউ খাওয়াতে পারেনি আমাকে। যাই হোক, দান দান তিন দান। যদিও অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে রয়েছি আমি, তৃবু তৃতীয়বার যেন আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে ব্যাপারে আমি ব্যক্তিগতভাবে তদারক করব এবার। স্যামুয়েলকে খুন করে আসা উচিত ছিল আপনার।
মরেনি ও? দুঃখিত মুখভঙ্গি করল রানা।
অত দুঃখিত হওয়ার কিছুই নেই, মিস্টার মাসুদ রানা। এখনও মরেনি। ঠিকই, তবে মরবার আর বেশি বাকিও নেই। সামান্য কিছুক্ষণের জন্যে জ্ঞান। ফিরে পেয়েছিল ও, আমাদের সৌভাগ্য যে ওইটুকু সময়ের মধ্যেই মাঠের মহিলাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিল বেচারী। হাসপাতালে দেয়া হয়েছে, কিন্তু স্কাল ফ্র্যাকচার আর ব্রেন হেমারেজ কাটিয়ে ওঠা ওর পক্ষে সম্ভব হবে। কিনা বলতে পারছে না ডাক্তাররা। এইটুকু বলেছে, যদি বাঁচেও, কোনদিন আর স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে পারবে না স্যামুয়েল।
খুব একটা দুঃখ বোধ করতে পারছি না খবরটা শুনে। সহজ কণ্ঠে বলল, রানা।
তা তো বটেই, মাথা ঝাঁকাল রেভারেন্ড রজার অমায়িক ভঙ্গিতে। কিন্তু কেউ কেউ আবার করছে। এই যেমন স্পিনোযা…মানে, চার্চ থেকে। গাড়িতে করে যে ছেলেটা এল আমার সাথে ওর কলজেটা ফেটে যেতে চাইছে দুঃখে-হাজার হোক, আপন ভাই। হঠাৎ সচকিত হয়ে ওঠার ভঙ্গি করল রজার, কিন্তু বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আর কতক্ষণ গল্প করবেন? চলুন, ভেতরে চলুন! হাসল লজ্জিত হাসি। আমি কিন্তু পিস্তলের ব্যাপারে খুবই আনাড়ি লোক। প্রয়োজনের বেশি সামান্য একটু নড়াচড়া দেখলেই টিপে দিই ট্রিগার।
পেছনের একটা দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকল রানা। সোজা এসে থামল সেই ঘড়ি ঘরে। রানাকে দেখে বিন্দুমাত্র বিস্মিত হলো না স্পিনোর্য। বোঝা গেল, অনেক আগেই সাবধানবাণী পেয়ে গেছে ওরা হাইলার থেকে।
এই যে, স্পিনোযা, পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে রজার, ইনিই হচ্ছেন সেই স্বনামধন্য মেজর মাসুদ রানা। বাংলাদেশের স্পাই। অ্যামস্টার্ডামে এসেছেন। ইন্টারপোলের সহযোগিতায় আমাদের অর্গানাইজেশনটা ধ্বংস করে দিতে।
পরিচয় আগেই হয়েছে আমাদের, গম্ভীর গলায় বলল স্পিনোযা।
ওহ-হো, কি ভুলো মন আমার! ভুলেই গিয়েছিলাম। রানার দিকে পিস্তল ধরে রাখল রজার, একপাশ থেকে কাছে এগিয়ে রানার পিস্তল বের করে নিল। স্পিনোযা।