অনেক কাজ পড়ে রয়েছে ওর সামনে।
.
বিকেলের দিকে ফিরল রানা অ্যামস্টার্ডম। মার খেয়ে ফুলে গেছে চোখমুখ, হঠাৎ দেখলে চিনবার উপায় নেই, বামচোখ বুজে গেছে অর্ধেকটা। চোয়ালে, কপালে প্লাস্টার।
শহরে পৌঁছেই একটা হায়ার-গ্যারেজের কাছে পুলিস-ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিয়ে ছোট্ট একটা কালো অস্টিন ভাড়া নিল সে চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে। রওনা হওয়ার সময় ট্যাক্সিটার কাছে থেমে বিট্রিক্সের হ্যাঁন্ডব্যাগটা তুলে নিল এ। গাড়িতে। সোজা এসে থামল অস্টিন একটা পরিচিত সাইড রোডে। গাড়ি। থেকে নেমে কয়েক গজ এগিয়ে একটা মোড় ঘুরতে গিয়ে চট করে সরে এল সে, তারপর সাবধানে উঁকি দিল আবার।
আমেরিকান হিউগানট সোসাইটির ফার্স্ট রিফর্মড় চার্চের সামনে দাঁড়িয়ে। রয়েছে একটা মার্সিডিজ টু টোয়েন্টি। সাদা। হাঁ করা রয়েছে পেছনের বুট, তার মধ্যে ভারী একটা বাক্স তুলছে দুজন লোক। প্রশস্ত বুটে আগেই ভোলা। হয়েছে একই চেহারার আরও তিনটে বাক্স। চুলপাকা, হাসিখুশি লোকটাকে তিন মাইল দূর থেকেও চেনা যাবে অতি সহজে-রেভারেন্ড ডক্টর নিকোলাস। রজার। দ্বিতীয়জনের মাথায় ঘন কালো চুল, মুখে বয়সের ভাজ, দুই চোখের নিচে ফুলে রয়েছে দুটো থলে, উচ্চতা মাঝারি, হালকা-পাতলা গড়ন, চেহারা দেখলেই মনে হয় ভয়ানক নিষ্ঠুর। হাতে আজ এয়ারব্যাগ নেই, কিন্তু এক নজরেই চিনতে পারল রানা ইসমাইল আহমেদের হত্যাকারী। ঠাণ্ডামাথায় খুন করেছিল লোকটা ইসমাইলকে শিফল এয়ারপোর্টে, ওর চোখের সামনে। মুহূর্তে মাথার যন্ত্রণা আর অস্বাভাবিক শারীরিক ক্লান্তি দূর হয়ে গেল রানার। গত কয়েকদিন শয়নে স্বপনে বারবার এই লোকটার চেহারাটা ভেসে উঠেছে রানার মানসপটে, যেখানেই গিয়েছে–হোটেল, রেস্তোরাঁ, নাইট-ক্লাব–সব। জায়গায় নিজের অজান্তেই খুঁজেছে সে এই লোকটাকে।
আরও একটা বাক্স নিয়ে বেরিয়ে এল ওরা গির্জা থেকে, এলোমেলো পা ফেলে এগিয়ে এসে তুলল বুটে। বুট বন্ধ করে দুজনকে গাড়ির দুই দরজা। খুলতে দেখেই একছুটে ফিরে এল রানা অস্টিনটার কাছে। গলির ভেতর ঢুকে মোড় নিয়েই দেখতে পেল সে প্রায় একশো গজ সামনে গদাই লশকরী চালে চলেছে মার্সিডিজ। বেশ অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখে পিছু নিল রানা।
শহরের ভিড় এড়িয়ে মার্সিডিজকে মোটামুটি দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে এগোতে দেখেই বুঝে নিল রানা ওটার গন্তব্যস্থল। নিশ্চয়ই চলেছে ক্যাসটিল লিভেনের দিকে। শহরতলি ছাড়িয়ে একটা মাইলপোস্টে দেখতে পেল রানা, আর তিন কিলোমিটার আছে ক্যাসটি লিন্ডেনে পৌঁছুতে। বারকয়েক হর্ন বাজিয়ে। একটা ট্রাক মাসির্ডিজকে ওভারটেক করছে দেখে অ্যাকসিলারেটর টিপে ধরল। রানা। সামনে বেড়ে থাকাই ভাল। ট্রাককে সাইড দিল ডক্টর রজার, ট্রাকের পেছন পেছন রানাও বেরিয়ে গেল পাশ কেটে। মুখটা ঘুরিয়ে রাখল সে, কিন্তু পরিষ্কার টের পেল, মার্সিডিজের আরোহীদের কেউই চাইল না ওর দিকে। চাইবার কথাও না। চাইলেও চিনতে যে পারবে না, সে ব্যাপারে একেবারে নিশ্চিত ছিল রানা। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় স্যামুয়েলের হাতে ছেড়ে দিয়ে এসেছে রজার রানাকে, কল্পনাও করতে পারবে না যে সেই রানাই ভিন্ন গাড়ি চালিয়ে ওভারটেক করছে ওকে।
.
মাইলখানেক গিয়ে ট্রাক চলে গেল বায়ে, রানা ধরল ডাইনের রাস্তা। আরও কিছুদূর গিয়ে তীরচিহ্ন আঁকা নির্দেশিকা দেখতে পেল সে, সেই রাস্তা ধরে এক কিলোমিটার এগোতেই দেখতে পেল প্রকাণ্ড এক খিলান। খিলানের উপর সোনালি অক্ষরে লেখা রয়েছে ক্যাসটিল লিড়েন। শদুয়েক গজ এগিয়ে গেল রানা, তারপর একটা ঘন ঝোঁপের আড়ালে গাড়িটা লুকিয়ে রেখে চাইল চারপাশে। বামদিকে পাইনের জঙ্গল, জঙ্গলের ফাঁকে ফাঁকে দুর্গের এক আধটা অংশ দেখা যাচ্ছে। গাড়ি থেকে নেমে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে শুরু করল রানা সোজা দুর্গের দিকে। জঙ্গলের শেষে বুক সমান উঁচু ঘাসের ফাঁক দিয়ে মুখ বের করে চাইল সে সামনের দিকে।
সামনেই কাঁকর বিছানো রাস্তা দেখা যাচ্ছে-খিলানের নিচ দিয়ে এসে সামান্য বাঁকা হয়ে গিয়ে শেষ হয়েছে দুর্গের সামনে। চারতলা দুর্গ, দুর্গের মাথায় গম্বুজ, গায়ে মধ্যযুগীয় কারুকাজ, চারপাশে বিশ ফুট চওড়া পরিখা। কাকর বিছানো রাস্তাটা গিয়ে শেষ হয়েছে পরিখার সামনে। ওখান থেকে দুর্গে। প্রবেশ করবার জন্যে এককালে যে ড্র-ব্রিজের ব্যবস্থা ছিল, তার প্রমাণ হিসেবে। দেয়ালের গায়ে বসানো প্রকাণ্ড দুটো কপিকল রয়েছে এখনও। কিন্তু এখন আর। ড্র-ব্রিজের ব্যবস্থা নেই, পরিখার উপর একটা স্থায়ী ব্রিজ তৈরি করে নেয়া। হয়েছে। ব্রিজের ওপরে প্রকাণ্ড এক ওক কাঠের দরজা। বন্ধ। রানার বামদিকে, দুর্গ থেকে গজ তিরিশেক দূরে একটা চৌকোণ একতলা দালান, ইটের–দেখে বোঝা যায় বড়জোর বছর তিনেক আগের তৈরি।
খিলানের নিচ দিয়ে এপাশে চলে এল সাদা মার্সিডিজ। কাঁকর বিছানো রাস্তার উপর দিয়ে খৈ ভাজার আওয়াজ তুলে একতলা দালানের সামনে গিয়ে। থামাল গাড়িটা। ড্রাইভিং সীটে বসে রইল ডক্টর রজার, পাশের লোকটা গাড়ি থেকে নেমে গোটা দূৰ্গটা ঘুরে এল একপাক। এবার নিশ্চিন্ত হয়ে গাড়ি থেকে নেমে একতলা বাড়ির একটা দরজায় চাবি লাগাল নিকোলাস রজার, দরজা দুপাট হাঁ করে খুলে রেখে দুজন মিলে নামাতে শুরু করল বাক্সগুলো। একটা করে বের করে, ভেতরে কোথাও রেখে আসে সেটা, আবার নামায় একটা। শেষ বাক্সটা ভেতরে নেয়া হতেই বন্ধ হয়ে গেল দরজা।