ফ্লোর-ওয়েটারের কাছে শেখা গোটাকয়েক বাছা বাছা ডাচ গালি ঝেড়ে দিল রানা।
কয়েক সেকেন্ড বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল স্যামুয়েল রানার মুখের দিকে, তারপর খোলস ছেড়ে বিষধর সাপ হয়ে গেল মুহূর্তে। চারপাশ থেকে বৃষ্টির মত শুরু হয়ে গেল ঘুসিবর্ষণ। পিস্তল এবং হাতের মুঠি, দুটোই ব্যবহার করছে সে। নাক, মুখ, চোখ, কান, ঘাড়, পিঠবাদ দিচ্ছে না কিছুই। নাকমুখের আঘাতগুলো যতটা সম্ভব দুই বাহুর আড়ালে ঠেকাবার চেষ্টা করল রানা, ফলে শেষের দিকে বুক, পিঠ আর পেটের উপরই পড়ল বেশির ভাগ আঘাত। স্যামুয়েলের দুই চোখে উন্মাদের দৃষ্টি। ফোঁস ফোঁস হাপাচ্ছে, বক্সারের মত লাফাচ্ছে রানার চারপাশে, প্রয়োজন নেই, তবু অভ্যাসবশে একটা হাত বারবার উঠে আসছে ওর নাকের কাছে নাকটা গার্ড দেয়ার জন্যে। প্রতিটা আঘাতে ককিয়ে উঠল রানা, দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করল, তারপর সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ল ওর মাথাটা, পা দুটো সামান্য ভাঁজ হয়ে। ঝুলে রইল হাতবাধা অবস্থায়।
আরও কয়েকটা ঘুসি মারবার পর বুঝতে পারল স্যামুয়েল, অনর্থক সময়– ও শক্তি নষ্ট করছে সে। থেমে গেল। কেউ যন্ত্রণা বোধ করবার ক্ষমতা হারিয়ে। ফেললে তাকে নির্যাতন করবার কোন অর্থই হয় না। নাক দিয়ে অদ্ভুত একটা শব্দ বের করে বিরক্তি প্রকাশ করল সে। কয়েকহাত দূরে সরে গিয়ে দম নিচ্ছে। ফোঁস ফোঁস করে। এরপর লোকটা ঠিক কি করতে যাচ্ছে বুঝতে পারল না। রানা, চোখ খুলতেও সাহস পেল না।
স্যামুয়েলের পায়ের শব্দ শুনে আবার মার শুরু হতে যাচ্ছে কিনা বুঝবার। জন্যে আড়চোখে চাইল সে এক চোখের পাপড়ি সামান্য একটু ফাঁক করে। খ্যাপামি দূর হয়ে গেছে লোকটার। রানার কোটটা তুলে নিল মেঝে থেকে। উপরি যা পাওয়া যায় তাই লাভ। একের পর এক পরীক্ষা করছে পকেটগুলো। কিছুই পাওয়া যাবে না ওখানে। হাতে ঝোলানো কোটের পকেট থেকে মানিবাগ পড়ে যাবে বলে প্যান্টের হিপ-পকেটে রেখেছে সেটা রানা কোট খোলার আগেই। ব্যাপারটা বুঝতে বেশি সময় লাগল না স্যামুয়েলের। পায়ের শব্দ পাওয়া গেল। রানার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে লোকটা, বের করে নিল মানিব্যাগ হিপ-পকেট থেকে।
রানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে স্যামুয়েল। দেখতে পাচ্ছে না, কিন্তু অনুভব করতে পারছে রানা। অস্ফুট একটা গোঙানির মত শব্দ করে বরগার সাথে ঝুলন্ত অবস্থায় পাশ ফিরল রানা। অসহায় ভঙ্গিতে মেঝে স্পর্শ করে রয়েছে। ওর জুতোর ডগা। বাম চোখটা এক ইঞ্চির যোলো ভাগের এক ভাগ খুলল।
প্রথমেই চোখ পড়ল স্যামুয়েলের জুতোর দিকে। তিন ফুট দূরে এইদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে লোকটা। চট করে একবার চোখ তুলেই নামিয়ে নিল, রানা। অত্যন্ত মনোযোগের সাথে রানার মানিব্যাগ থেকে ছোটবড় হরেক মানের, হরেক দেশের নোটগুলো বের করে নিজের পকেটে পুরছে স্যামুয়েল! এত টাকা পেয়ে যাবে কল্পনাও করতে পারেনি হয়তো সে। বামহাতে মানিব্যাগটা ধরে ডানহাতে আরও নোট বের করছে আরেক খোপ থেকে। ট্রিগারগার্ডের মধ্যে দিয়ে বামহাতের মাঝের আঙুল বাকিয়ে পিস্তলটা ধরে রেখেছে আলগাভাবে। এতই ব্যস্ত রয়েছে টাকা বের করবার কাজে যে লক্ষই। করল না রানার হাতদুটো একটু উপরে উঠে আকড়ে ধরুল রশির দুমাথা।
ঝট করে দুভাঁজ হয়ে গেল রানার শরীর। শরীরের সমস্ত শক্তি রাগ আর ঘৃণা একত্রিত করে উপর দিকে চালাল সে জোড়া পা। এতই দ্রুত, যে কোথা দিয়ে কি হয়ে গেল টেরই পেল না স্যামুয়েল বাকা হয়ে হুমড়ি খেয়ে রানার গায়ের উপর পড়ল ওর শরীরটা, নিঃশব্দে, তারপর গড়িয়ে পড়ে গেল মেঝের উপর। চিত হয়ে শুয়ে দাতে দাঁত চেপে চোখ বুজে মাথাটা এপাশ-ওপাশ করছে স্যামুয়েল, তীব্র যন্ত্রণায় এতই বিকৃত হয়ে গেছে মুখের চেহারা যে চেনাই যাচ্ছে না। খিচুনি শুরু হয়ে গেছে ওর হাতপায়ে। জানোয়ার হয়ে গেল। রানাও। নির্মমভাবে লাথির পর লাথি মেরে চলল ওর নাকে, মুখে, কানের পাশে, মাথার তালুতে; যতক্ষণ না স্থির হয়ে গেল দেহটা, থামল না। তখন আর চাওয়া যায় না থ্যাতলানো রক্তাক্ত দেহটার দিকে।
বাম হাতের মাঝের আঙুলটা বাকা করে তেমনি ধরে আছে স্যামুয়েল পিস্তলের ট্রিগারগার্ড। পা বাড়িয়ে নিঃসাড় আঙুলের ফাঁক থেকে টেনে আনল রানা পিস্তলটা নিজের কাছে। বারকয়েক দুই পায়ের জুতো দিয়ে পিস্তলটা আঁকড়ে ধরে উপরে তুলবার চেষ্টা করে বিফল হলো। বারবারই পিছলে পড়ে যায় নিচে। বহুকষ্টে, প্রায় বিশ মিনিটের চেষ্টায় দুই পায়েরই জুতো এবং মোজা খুলে ফেলল সে মেঝের উপর পায়ের গোড়ালি ঘষে।
খালিপায়ে পিস্তলটা চেপে ধরতেই সুন্দর উঠে এল। দুইহাত জড়ো করে। রশিদুটো একত্র করল সে, তারপর ওটা বেয়ে উঠে গেল বরগা পর্যন্ত। বামহাতে বরগাটা ধরে ফেলতেই চারফুট আন্দাজ ঢিল পেল সে ডান হাতের রশিতে। এবার শরীর বাঁকা করে পা দুটো যতদূর সম্ভব উপরে তুলতেই পিস্তলটা চলে এল ওর হাতে।
নিচে নেমে এল রানা, বাম হাতের কব্জির কাছে রশির গায়ে সাইলেন্সারের মুখটা ঠেকিয়ে টিপে দিল ট্রিগার। যেন ছুরি দিয়ে কাটা হয়েছে, এমনি নিখুঁত ভাবে রশি কেটে বেরিয়ে গেল গুলিটা। তিন মিনিটের মধ্যে সব দড়ি খসিয়ে জুতো মোজা পরে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল রানা। স্যামুয়েলের পকেট থেকে টাকাগুলো উদ্ধার করে আবার ভরে নিল মানিব্যাগে। খড়ের গাদা থেকে নিজের পিস্তলটা তুলে নিয়ে নিঃশব্দ পায়ে নেমে গেল সিঁড়ি বেয়ে। স্যামুয়েলের ক্ষতবিক্ষত চেহারা দেখে মনে হলো মরেই গেছে লোকটা, কিন্তু সত্যিই মরেছে কি মরেনি পরীক্ষা করে দেখবার প্রয়োজন বোধ করল না সে।