আর চেয়ে থাকতে না পেরে মাথাটা একপাশে ফেরাল রানা। চোখ পড়ল ইরিনের উপর। হাতদুটো খুলছে আর মুঠি পাকাচ্ছে ইরিন, মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে রয়েছে সামনের দিকে, মুখে বন্যজন্তুর হিংস্রতা। ওর কাঁধের উপর, হাত রেখে তেমনি দাঁড়িয়ে রয়েছে রেভারেন্ড রজার, মুখে সরল হাসি, কিন্তু ধকধক করে জ্বলছে চোখদুটো। আদিম, জংলী বাজনা অমানুষ করে দিয়েছে। সবাইকে।
বাজনাটা কমে এল। ঢিল হয়ে গেল ছন্দ। ফকহাতে খানিকটা দূরে সরে গেল সবাই, নাচের ছন্দে খানিকটা করে খড় তুলে ছুঁড়ে দিচ্ছে ওরা বৃত্তের মাঝখানে। এক মুহূর্তের জন্য ঘাসের উপর কুকুরের মত ককড়ে পড়ে থাকা লাশটা দেখতে পেল রানা, রক্তে ভিজে লাল হয়ে গেছে সাদা রাউজ। পরমুহর্তে ঢাকা পড়ে গেল শরীরটা খড়ের নিচে। অ্যাকর্ডিয়ানের ধীর ছন্দের। সাথে তাল মিলিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই উঁচু একটা খড়ের গাদা তৈরি করে। ফেলল ভাবলেশহীন মহিলারা। থেমে গেল বাজনা। শেষ।
রেভারেন্ড ডক্টর রজারের হাত ধরে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে গল্প করতে করতে শহরের দিকে হাঁটতে শুরু করল ইরিন, পেছন পেছন প্রশান্তবদনে চলল। মারগ্রিয়েট। হাতে সেই মস্ত চামড়ার ব্যাগ।
.
০৮.
মস্ত এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাঠের ফাঁক থেকে চোখ সরাল স্যামুয়েল।
দারুণ। তাই না?মাথা কাত করে একটা ভুরু উঁচু করে প্রশংসার ভঙ্গি করল সে। এসব ব্যাপারে ডক্টর রজারের তুলনা হয় না। হত্যা তো নয়, যেন শিল্পকর্ম। একেক সময় ধিক্কার এসে যায় নিজের ওপর। শালার জীবনভর কি শিখলাম! এইরকম একটা সর্বাঙ্গসুন্দর মৃত্যু দেখলে মনে হয় সার্থক হলো জন্মটা। গ্র্যান্ডমাস্টার! মুগ্ধ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল এপাশ-ওপাশ। তারপর ভাবের ঘোর কাটিয়ে উঠে ফিরল রানার দিকে। ওর চোখের দিকে চাইলে মনে হয় এক্ষুণি বুঝি সাপের মত লকলকে জিভ দেখা যাবে ঠোঁটের ফাঁকে। আমার কিন্তু আবার চিৰ্কার না শুনলে মজা লাগে না। গলা ফাটিয়ে চ্যাচাবে, তবে না খেলা!
রানার পেছনে এসে দাঁড়াল লোকটা। ঘাড়ের পেছনে রুমালের গিঠ খুলে মুখ থেকে বের করে মেঝের উপর ফেলল দ্বিতীয় রুমাল, ভালটা ভাজ করে। রেখে দিল নিজের পকেটে। সামনে এসে দাঁড়াল। ঢোক-টোক গিলে তৈরি হয়ে নাও বাছা! খুব জোরে চাচাতে হবে এখন।
কিন্তু আর শ্রোতা কই? নিজের গলা নিজেই চিনতে পারল না রানা। অত্যন্ত কর্কশ আর মোটা হয়ে গেছে গলাটা। বলল, এমন আনন্দ থেকে ডক্টর রজারকে বঞ্চিত করা কি ঠিক হবে?
বাঁকা হাসি হাসল স্যামুয়েল। উনি কল্পনা করে নিতে পারবেন। আটিস্ট মানুষ। এখানে কি ঘটছে সেটা কল্পনা করে নিতে মোটেই কষ্ট হবে না ওর। জরুরী কাজে এক্ষুণি অ্যামস্টার্ডামে ফিরে যেতে হচ্ছে ওকে, নইলে হাতেপায়ে। ধরে রেখে দিতাম যেমন করে থোক। আমার কাজে আর্ট কম, কিন্তু কাজ বড় সলিড। নিজ চোখে দেখলে উনি খুশিই হতেন। কিন্তু কি আর করা, অ্যামস্টার্ডামে ফিরে যাওয়াটা এতই জরুরী…
শুধু ফিরে যাওয়া নয়, গুরুত্বপূর্ণ কিছু বয়ে নিয়ে যাওয়াও।
সে তো বটেই, মৃদু হাসল স্যামুয়েল। দেখো, মাসুদ রানা, তুমি বোধহয় কিছু একটা জেনে ফেলেছ, এইরকম একটা ভাব দেখিয়ে কথা বাড়াবার তালে আছ। গল্পের বইয়ে যেমন দেখা যায় কথা বলে দেরি করিয়ে দিতে পারলেই কেউ এসে উদ্ধার করে ফেলে নায়ককে; হয়তো সহকারী, নয়তো পুলিস। আমি তোমাকে আশ্বাস দিতে পারি, চাই কি কসম খেয়েও বলতে পারি, এখানে কারও সাহায্য পাবে না তুমি। এই গোলাবাড়ির আধমাইলের মধ্যে কাউকে দেখা গেলে সাথে সাথেই জানানো হবে আমাকে, এবং সাথে সাথেই কাজ শেষ করে আগুন ধরিয়ে দেব আমি গোটা বাড়িতে। গল্পের বইয়ের নিয়ম অনুযায়ী আমার এখন উচিত নির্যাতনের আগে লম্বা-চওড়া কিছু বক্তৃতা দিয়ে নিজের ভিলেন রোলটা আরও একটু ফুটিয়ে তোলা। কিন্তু আমাদের এ গল্প লেখা হবে না কোনদিন। কাজেই ওসব ডিঙিয়ে সরাসরি কাজে নেমে যাওয়া যাক। কি বলো? শুরু করি? এক পা এগিয়ে এল স্যামুয়েল।
পরিষ্কার বুঝতে পারছে রানা, আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে প্রলয়কাণ্ড। কথা ফুরিয়ে এসেছে। কথা দিয়ে আর দেরি করানো যাবে না ওকে। হঠাৎ যে কিছু একটা ঘটে গিয়ে উদ্ধার পেয়ে যাবে সে আশাও নেই। তব, নিছক দেরি করাবার জন্যেই বলল, কি শুরু করবে?
মিস্টার গুডবডির শুভেচ্ছাবাণী। বলেই ধাই করে পিস্তলের নল দিয়ে মারল স্যামুয়েল রানার বাম চোয়ালে। তীব্র ব্যথায় ককিয়ে উঠল রানা। মনে হলো, এক আঘাতেই তো হয়ে গেছে চোয়ালের হাড়, কিন্তু জিভটা নেড়েই বুঝতে পারল হাড় ভাঙেনি, দাঁত খসে গেছে একটা। আসল নয়, বাঁধানো দাঁতটা।
মিস্টার গুডবডি তোমাকে জানাতে বলেছেন যে পিস্তলের ফোরসাইট দিয়ে গাল চিরে দেয়া মোটেই পছন্দ করেন না উনি, বাঁকা হাসি হেসে বামহাতে নিল স্যামুয়েল পিস্তলটা, সাই করে চালাল ডান গাল লক্ষ্য করে। মাথাটা সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল রানা, কিন্তু তাতে আঘাত এড়ানো গেল না। দড়াম করে ডান চোয়ালের উপর প্রচণ্ড আঘাত পড়ল। বাধানো দাঁতটা ছিটকে বেরিয়ে গেল মুখ থেকে। সেই সাথে আত্মহত্যার সুযোগও। ওই দাঁতের মধ্যেই লুকানো ছিল ওর সায়ানাইড ক্যাপসুল। কয়েক সেকেন্ডের জন্যে চোখে কিছুই দেখতে পেল না রানা, মাথাটা ঘুরে উঠেছে, তীক্ষ্ণ যন্ত্রণায় মনে হলো জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে এক্ষুণি। কিন্তু বুদ্ধিটা ঘোলা হলো না। মোটেই। পরিষ্কার বুঝতে পারল সে, স্যামুয়েলকে ঠাণ্ডা মাথায় অত্যাচার, করতে দিলে কপালে অনেক দুঃখ আছে ওর, যেমন করে থোক রাগিয়ে দিতে হবে ওকে।