সত্যিই খুব ভাল। কিন্তু আমার এখন যেতে হবে, ইরিন। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে…কেনাকাটা করতে হবে। অনেক কিছু। আমি এখন চলি, কেমন?
দুটো পিয়ানো অ্যাকর্ডিয়ান বেজে উঠল হঠাৎ। বাদকদের দেখতে পেল রানা, মনে হলো সদ্যনির্মিত খড়ের গাদার ওপাশ থেকে ভেসে আসছে আওয়াজটা। টানা, মিষ্টি সুরেলা।
একলাফে উঠে দাঁড়িয়ে তিড়িংতিড়িং লাফাতে শুরু করল ইরিন। খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে চোখমুখ, বাচ্চা মেয়ের মত হাততালি দিচ্ছে। চেঁচিয়ে উঠল কী মজা! হে ডান্স! হে ডান্স দেখাবে আজ ওরা! তোমার জন্যে, মারিয়া তোমার সম্মানে। এখন তুমিও ওদের বন্ধু হয়ে গেলে!
খড়ের গাদার দিকে গজ দশেক সরে গিয়ে এদিকে মুখ করে সার বেধে দাঁড়াল মহিলা কর্মীরা। গভীর। কারও মুখে কোন ভাবের লেশমাত্র নেই। হে ফর্কগুলো রাইফেলের মত কাঁধের উপর রেখে বাজনার তালে তালে এক পা। সামনে আসছে আবার এক পা পিছিয়ে যাচ্ছে, এক পা ডাইনে সরছে, আবার ফিরে আসছে নিজের জায়গায়। তারপর আবার বায়ে। লাল রিবন বাধা পিগটেল দুলছে তালে তালে। বাজনার আওয়াজ বাড়ছে ক্ৰমে। সামনে পেছনে, ডাইনে-বামে স্টেপ ফেলছে, আর মাঝে মাঝে পাই করে একপাক ঘুরছে সবাই গম্ভীর মুখে। রানা লক্ষ করল, ধীরে ধীরে অর্ধবৃত্তাকারে গোল হয়ে আসছে লাইনটা।
অদ্ভুত! মারিয়ার কণ্ঠস্বর শুনতে পেল রানা। এই ধরনের ফোক-ডান্স জীবনে দেখিনি আমি।
আর কোনদিন দেখবেও না, বলল ইরিন। সত্য কথাটা সহজ সরল ভাষায় ইরিনের মুখ থেকে বেরিয়ে আসায় ভেতর ভেতর শিউরে উঠল রানা। ক্যাচ করে যেন চেপে ধরল কেউ ওর কলেজাটা আগুনে-লাল এক সাড়াশি দিয়ে। কি ঘটতে চলেছে, আঁচ করতে পারছে রানা, কিন্তু সাবধান করবার কোন উপায় নেই। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল ইরিন, আরে! দেখো মারিয়া, তোমাকে ডাকছে। তোমাকে পছন্দ হয়েছে ওদের!
আমাকে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ তোমাকে ডাকছে। মাঝে মাঝে আমাকে ডাকে, কোনদিন মারগ্রিয়েটকে। আজ ডাকছে তোমাকে।
যেতে হবে আমাকে। আর একদিন…
প্লীজ, মারিয়া, প্লীজ! বেশি না, পাঁচমিনিট। তোমার কিছুই করতে হবে।, তুমি শুধু ওদের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকবে। প্লী-ই-জ! না গেলে ওরা, খুব দুঃখ পাবে। বা অনিচ্ছাসত্তেও রাজি হতে হলো মারিয়াকে। হেসে বলল, আচ্ছা পাগল! ঠিক আছে, যাচ্ছি।
দাতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করল রানা, মাথা নাড়ল। যেন বারণ করতে চায় মারিয়াকে যেয়ো না, মারিয়া! পালাও! সামনে বিপদ!
চোখ বুজে কয়েক সেকেন্ডের বেশি থাকতে পারল না রানা। চোখ মেলে দেখল, আড়ষ্ট ভঙ্গিতে হেঁটে গিয়ে অর্ধবৃত্তের কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়াল মারিয়া, মুখে সলজ্জ হাসি। চেহারা দেখে বোঝা গেল অত্যন্ত অপ্রস্তুত বোধ করছে। হেফক কাঁধে নিয়ে বাজনার তালে তালে একবার সামনে আসছে, একবার পিছিয়ে যাচ্ছে মহিলারা। ক্রমে বাড়ছে নাচের ছন্দ। গোল করে ঘিরে ফেলল ওরা মারিয়াকে। মাথাটা সামনের দিকে ঝুঁকিয়ে তিন পা এগিয়ে আসছে ওরা। মারিয়ার দিকে, বৃত্তটা সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে, আবার মাথা পেছন দিকে হেলিয়ে সরে যাচ্ছে তিন পা। বাজনার তালে তালে বৃত্তটা ছোট হচ্ছে, বড় হচ্ছে, ছোট হচ্ছে, বড় হচ্ছে।
নিকোলাস রজারকে দেখতে পেল রানা। মুখে প্রফুল্ল হাসি। বাতাসে। উড়ছে শুভ্রকেশ। ইরিনের পাশে দাঁড়িয়ে একটা হাত রাখল ওর কাঁধে। ঘাড় বাকিয়ে চকচকে চোখে চাইল ইরিন বৃদ্ধের মুখের দিকে।
রানার মনে হলো, এক্ষুণি বমি হবে ওর। শীতল ঘাম দেখা দিয়েছে ওর কপালে। চেষ্টা করেও চোখ ফেরাতে পারছে না সে মারিয়ার দিক থেকে। পাগলের মত টানাটানি করল সে হাতের রশি-কব্জির উপর আরও চেপে বসল রশির ফাস, লাভ হলো না কিছুই। মারিয়ার মুখের অপ্রস্তুত ভাবের সাথে। বিস্ময় যুক্ত হয়েছে এখন, সেইসাথে প্রকাশ পাচ্ছে আবছা অস্বস্তি। গভীর ভাবলেশহীন মুখে নেচেই চলেছে মহিলারা। দুজনের ফাঁক দিয়ে উদ্বিগ্নদৃষ্টিতে ইরিনের দিকে চাইল মারিয়া। আনন্দে স্থির থাকতে পারছে না ইরিন, হাত নেড়ে উৎসাহ দিল মারিয়াকে।
হঠাৎ ছন্দ এবং সুর পরিবর্তন করল অ্যাকর্ডিয়ানগুলো। ছন্দ বেড়ে গেল। দ্বিগুণ। সেই সাথে আওয়াজ। আশ্চর্য এক কর্কশ, আদিম সুরে গরম হয়ে উঠল পরিবেশটা মূহর্তে। শ্রোতার রক্তে যেন নাচন ধরিয়ে দিতে চাইছে বাদকরা। ক্রমেই ঘন হয়ে আসছে মহিলারা। মারিয়ার দুচোখ ঈষৎ বিস্ফারিত। ভয় পেয়েছে। একপাশে সরে ইরিনের দিকে চাইল সে সন্ত্রস্ত দৃষ্টিতে। কিন্তু। সেখানে ভরসার কোন ছাপ দেখতে পেল না। হাসি মুছে গেছে ইরিনের মুখ। থেকে, গ্লাভস পরা হাতদুটো জড়ো করে মুঠি পাকিয়ে দমন করবার চেষ্টা করছে সে তার মানসিক উত্তেজনা, কুৎসিত ভঙ্গিতে চাটছে নিচের ঠোঁট। রাগে, দুঃখে, অনুশোচনায় পানি বেরিয়ে এল রানার চোখ দিয়ে। স্যামুয়েলের দিকে চাইল। চার পাঁচ হাত দুরে আর একটা ফাঁকে এক চোখ আর রানার উপর আরেক চোখ রেখে দুদিকের দৃশ্যই উপভোগ করছে স্যামুয়েল। পিস্তলটা স্থির হয়ে রয়েছে রানার দিকে। অবধারিত অদৃষ্টকে মেনে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় দেখতে পেল না রানা।
মারিয়াকে গোল করে ঘিরে মহিলারা অনেক ছোট করে এনেছে বৃত্তটাকে। ওদের নির্বিকার, ভাবলেশহীন মুখে ফুটে উঠেছে এখন নির্মম ঘৃণা। মারিয়ার বিস্ফারিত চোখের ভীতি দেখতে দেখতে রূপান্তরিত হলো তীব্র আতঙ্কে। পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে গেছে মারিয়া। আরও তীব্র, আরও আদিম হয়ে উঠছে বাজনা। এমনি সময়ে, অকস্মাৎ, রাইফেলের মত করে কাঁধের উপর রাখা হেফকগুলো সাই করে নামিয়ে বেয়োনেটের মত করে ধরল সবাই মারিয়ার দিকে। প্রাণপণে চিৎকার করল মারিয়া, একবার দুবার নয়, বহুবার; কিন্তু অ্যাকর্ডিয়ানের শব্দ ছাপিয়ে শোনা গেল না কিছুই। চারপাশে চেয়ে কোনদিকে মুক্তির পথ দেখতে পেল না মারিয়া। চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছে ওকে হেফর্কের কাটা। পাগলের মত সামনে পেছনে পা ফেলছে সবাই উদ্দাম ছন্দে। মারিয়ার অভিম চিৎকারের সামান্য একটু রেশ পৌঁছুল রানার কানে। দুইহাতে নিজের কান চেপে ধরবার চেষ্টা করল সে, কিন্তু পারল না। আর দেখা যাচ্ছে না, মাটিতে পড়ে গেছে মারিয়া! এখন শুধু পেছন থেকে দেখতে পাচ্ছে সে, শাবল চালানোর ভঙ্গিতে দ্রুতবেগে হে ফর্কগুলো উঠছে আর নামছে, উঠছে, নামছে। লাল হয়ে গেছে ফর্কগুলোর চকচকে কাটা।