অপ্রত্যাশিত মানে? সহজ কণ্ঠে প্রশ্ন করল রানা। আমার আগমন আশা করেননি বুঝি?
আশা করিনি বললে মিথ্যে বলা হবে। মাথা নাড়ল রেভারেন্ড। একজন ধর্মযাজক হিসেবে সেটা উচিত হবে না আমার। সত্যি কথা বলতে কি, গির্জার। সামনে ট্যাক্সি ড্রাইভারের ছদ্মবেশে আপনাকে সেদিন আশা করিনি ঠিকই, কিন্তু আজ আপনার আশাতেই ধৈর্যের সাথে প্রতীক্ষা করছিলাম আমরা। এগিয়ে এসে রানার ভাজ করা কোটের উপর থেকে পিস্তলটা তুলে নিল, যেন লেজ ধরে তুলছে সাতদিনের পচা, পোকা খিতখিতে বোয়াল মাছ, এমনি। মুখভঙ্গি করে ছুঁড়ে ফেলল ওটা খড়ের গাদার উপর। অমার্জিত, কদাকার যন্ত্র। এসব, রুচির কোন বালাই নেই।
তা ঠিক, বলল রানা। এসব স্তর অনেক আগেই পেরিয়ে গেছেন আপনি। হত্যার মধ্যে শিল্পীসুলভ সৃষ্টিশীলতা ছাড়া আপনার মন ভরে না আজকাল।
হ্যাঁ। আমার রিফাইনমেন্টের ডেমনস্ট্রেশন দেখতে পাবেন আর। কিছুক্ষণের মধ্যেই। গলার স্বর খুব একটা নিচু করবার প্রয়োজন বোধ করল না নিকোলাস রজার। কারণ নিচে মারগ্রিয়েটের খাবার ঘিরে রীতিমত হাট বসে গেছে–সবাই কথা বলছে একসাথে। গাদা করা খড়ের ওপাশ থেকে একটা ক্যানভাসের ব্যাগ নিয়ে এল রজার, লম্বা একটুকরো রশি বের করল। তার মধ্য থেকে। মাই ডিয়ার স্যামুয়েল, একটু সজাগ থেকো। মেজর মাসুদ। রানা যদি একটু নড়ে ওঠেন, সেটা সন্দেহজনক বা আক্রমণাত্মক হোক বা না হোক, গুলি করবে নিশ্চিন্তে। একেবারে মেরে ফেলো না আবার, হাঁটু কিংবা উরুতে বুঝতে পেরেছ?
ঠোঁট চাটল স্যামুয়েল। রানা ভয় পেল, ওর হৃৎপিণ্ডের প্রবল ধুকপুকানির। ফলে শার্টের অস্বাভাবিক কম্পনকে না আবার লোকটা সন্দেহজনক কিছু ভেবে বসে। পেছন দিক থেকে সাবধানে এগিয়ে এল রজার, রানার ডান হাতের কব্জিটা শক্ত করে বেঁধে মাথার উপরের মোটা একটা কাঠের বার উপর দিয়ে ঘুরিয়ে আনল রশির আরেক মাথা, তারপর এমনভাবে বাম হাতের কব্জিতে গিঠ দিল, যেন হ্যাঁন্ডস-আপের ভঙ্গিতে রানার হাতদুটো মাথার উপর। উঁচু হয়ে থাকে। রশির শেষ মাথাদুটো এমনভাবে উঁচু করে গিঠ দিল যেন কিছুতেই রানা হাতের নাগালে না পায়। এবার আর এক টুকরো অপেক্ষাকৃত ছোট রশি বের করল সে ব্যাগ থেকে।
যেন আন্তরিকতার সাথে গল্প করছে, এমনি গলায় বলল সে, স্যামুয়েলের কাছে জানতে পারলাম, আপনার হাতদুটোই কেবল নয়, পা-ও নাকি অস্বাভাবিক দ্রুত চলে। কাজেই ও দুটোকেও একটু শাসনের মধ্যে আনা। দরকার। দুই পা জোড়া করে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে কষে বেঁধে ফেলল সে, তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মিষ্টি হেসে বলল, এবার মুখেরও একটা ব্যবস্থা। হওয়া দরকার–কি বলো, স্যামুয়েল? মেজর রানা এখন যে দৃশ্য অবলোকন করতে যাচ্ছেন, নাটক চলাকালে সে ব্যাপারে ওর কাছ থেকে আমরা কোন মন্তব্য চাই না। ঠিক? অতএব তোমার রুমালটা বের করো। পকেট থেকে ময়লা একটা রুমাল বের করে দিল স্যামুয়েল, রানার মুখের ভেতর সেটা পুরে দিয়ে নিজের রুমাল দিয়ে মুখটা বেধে ঘাড়ের পেছনে গিঠ দিয়ে আত্মতৃপ্তির হাসি হাসল নিকোলাস বজার। কেমন বাধা হয়েছে, স্যামুয়েল? পছন্দ হয়েছে। তোমার?
জ্বলজ্বল করছে স্যামুয়েলের চোখ।
মিস্টার গুডবডির তরফ থেকে এর জন্যে কিছু শুভেচ্ছাবাণী রয়েছে। আমার কাছে, রেভারেন্ড। দিয়ে দেব?
আরে, না। অত অধৈর্য হলে কি চলে? পরে, পরে। আপাতত মেজর রানাকে আমরা পূর্ণ সচেতন, সজ্ঞান অবস্থায় চাই। দৃষ্টি বা শ্রবণ বা চিন্তাশক্তি কিছুমাত্র বিঘ্নিত হলে চলবে না। নইলে আমাদের শিল্পমাধুর্য পুরোমাত্রায় উপলব্ধি করবেন কি করে?
ঠিক আছে, রেভারেন্স, বিনয়ের সাথে মেনে নিল স্যামুয়েল। ঠোঁট চাটল নিস্পলক দৃষ্টিতে রানার দিকে চেয়ে। আপনি যখন বলেছেন, পরেই
হ্যাঁ, পরে। উদারতার অবতার যেন রজার। আমাদের শো-টা ভাঙলেই যত খুশি শুভেচ্ছা জানিয়ে দিতে পারো তুমি ওকে। কিন্তু একটা কথা মনে রেখো, রাতে যতক্ষণ না গোলাবাড়িতে আগুন ধরানো হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত যেন জীবিত থাকে। দুঃখের বিষয়, কাছেপিঠে কোথাও থেকে শেষ। দৃশ্যটা আমি নিজে উপভোগ করতে পারব না। মুখ দেখে সত্যিই দুঃখিত মনে হলো রজারকে। আপনার এবং আপনার ওই সুন্দরী সহকর্মিনীর পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া লাশ যখন ছাই ঘেঁটে বের করা হবে, সবাই অনায়াসে বুঝে নেবে। ব্যাপারটা–গোপন প্রেমের জ্বালা মেটাতে এসে জ্বলে মরেছেন। অসাবধানে ফেলা সিগারেটের একটি টুকরোই নিবিয়ে দিয়েছে আপনাদের সব জ্বালা। যাই হোক, চলি এখন, গুডবাই। আবার দেখা হবে–পরপারে। আমি এখন হে, ভান্স দেখতে যাচ্ছি। কাছে থেকে না দেখলে ওটার মজা নেই। আপনিও। দেখতে পাবেন ওই ফাঁক দিয়ে। এমন সুন্দর নাচ জীবনে দেখেননি আপনি, কোনদিন, আর দেখবেনও না।
কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল নিকোলাস রজার। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে সাপের মত পলকহীন চোখে চেয়ে রয়েছে স্যামুয়েল রানার চোখের দিকে, ঠোঁটের কোণে নিষ্ঠুর হাসির ভাজ। বাগে পেয়েছে সে এবার, পাওনা শোধ করে আরও কিছু অগ্রিম দিয়ে দেবে। কাঠের দেয়ালের ফাঁক দিয়ে। নিচের দিকে চাইল রানা।
কফি শেষ করে উঠে দাঁড়িয়েছে মহিলারা। মারিয়াও উঠে দাঁড়াল।
কফিটা খুব ভাল না, মারিয়া? আর কেকগুলো? খুশিখুশি গলায় জিজ্ঞেস করল ইরিন।