মাচাটার পূর্বদিকের অর্ধেকটা ভর্তি হয়ে রয়েছে গত বছরের খড়ে। ওদিকে না গিয়ে সাবধানে, প্রথমে হালকাভাবে পা ফেলে তার অবস্থা বুঝে নিয়ে তারপর ধীরে ধীরে শরীরের ওজন চাপিয়ে, এক পা দুপা করে পশ্চিম দিকে এগোল সে। পশ্চিম দেয়ালের কাছে পেছে সবার উপর নজর রাখবার। পক্ষে সবচেয়ে সুবিধাজনক একটা জায়গা বেছে নিয়ে দাঁড়াল রানা। ঠিক নিচেই দেখা যাচ্ছে বসে আছে ইরিন, মারিয়া আর মারগ্রিয়েট। একটু দূরে বারো-চোদ্দজন মাঝবয়সী মহিলা নিপুণ হাতে খড়ের গাদা তেরি করছে, ছয়ফুট লম্বা কাঠের হাতলের মাথায় কাঁটাচামচের মত ঘুচল লোহার পাতগুলো ঝকঝক করছে রোদ লেগে। ওদের মাথার উপর দিয়ে বহুদূরে কার-পার্কের একটা অংশ দেখতে পেল রানা।
আশ্চর্য একটা অস্বস্তি শিরশির করছে রানার সারা শরীরে। ঠিক কি কারণে যে শরীরের মধ্যে জাগছে এই বোধটা, অনেক ভেবেও কিছুতেই বুঝতে পারল না রানা। খড় গাদা করার দৃশ্য মনের মধ্যে একটা শাস্তির ভাব, একটা পরম নিশ্চিন্ত ভাব সৃষ্টি করবার কথা। গোটা পরিবেশটাই শান্ত, মঙ্গলময়। তবু কেন আবছা অস্বস্তিটা দূর হতে চাইছে না ওর মন থেকে? কেমন যেন একটা ভয় ভয় ভাব, বিপদের আশঙ্কা, অনিশ্চয়তা আর অবাস্তবতা অনুভব করতে পারছে রানা, কিন্তু ঠিক কিসের থেকে যে এর উৎপত্তি বুঝে উঠতে পারছে না। অবাস্তব শব্দটা পছন্দ হলো রানার। এই লাইনেই এগোবার চেষ্টা করল চিন্তার কয়েক ধাপ, কিন্তু আবছা ঠেকায় বাদ দিল। চিন্তা। তবে এটুকু বুঝতে অসুবিধে হলো না ওর, কর্মরতা গ্রাম্য মহিলাদের। দিকেই যখন বারবার দৃষ্টি যাচ্ছে ওর, গোলমালটা ওখানেই। নিজেদের অভ্যস্ত পরিবেশে কাজ করছে ওরা একমনে। অভ্যস্ত কাজ, অভ্যস্ত সাজ-কিন্তু তবু যেন ঠিক মানাচ্ছে না। ঝলমলে পোশাক, এমব্রয়ডারি, দুধ-সাদা উইমপল হ্যাট এই পরিবেশের সাথে খাজে খাজে মিলে যাওয়ার কথা; ওদের চেহারা, বয়স, কাজ, পরিবেশ, সবকিছুর সাথে মিলে যাওয়ার কথা কিন্তু কিসের যেন একটা অভাব অনুভব করতে পারছে রানা। একটা নাটক-নাটক অবাস্তব ভাব সবকিছুতে। কেন যেন আবছাভাবে ওর মনে হলো, বিশেষ করে ওরই জন্যে ব্যবস্থা করা হয়েছে এই নাটকের।
প্রায় আধঘণ্টা কেটে গেল, কোথাও কোন শান্তিভঙ্গ হলো না। তেমনি। নিরলস কাজ করে চলেছে মহিলারা, ছায়ায় বসে এদের তিনজনের মধ্যে। দুএকটা টুকরো কথা হচ্ছে, বেশির ভাগ সময়ই চুপ। পরিবেশটা এমনই শান্তিময় যে কথা বলে শান্তিতে বিঘ্ন ঘটাতে চাইছে না যেন কেউ। ফর্কের মাথায় খড় তুলে গাদার উপর ছুঁড়ে দেয়ার মৃদু খসখস শব্দ, কড়া রোদ, আলস্য, মাঝে মাঝে এক-আধটা বেপথু ভ্রমনের গুঞ্জন, দূর থেকে ভেসে আসা। কোন পাখির মিষ্টি সুরেলা ডাক–পরিবেশটা অন্তর দিয়ে অনুভব করবার, কথা বলে সোন্দর্যহানি ঘটাবার নয়। কোটটা ভাজ করে মেঝের উপর রেখে তার উপর রাখল পিস্তলটা, তারপর সাবধানে একটা সিগারেট ধরাল রানা। ঘন ধোয়াগুলোকে কখনও হাত নেড়ে, কখনও ফুঁ দিয়ে হালকা করে মিশিয়ে দিচ্ছে। বাতাসে।
আরও কয়েক মিনিট গেল। হাতঘড়িতে সময় দেখল মারিয়া, মারগ্রিয়েটও কব্জি উল্টে পকেট ওয়াচের সমান একটা হাতঘড়িতে সময় দেখল, নিচু গলায়কিছু বলল ইরিনকে। উঠে দাঁড়াল ইরিন, মারিয়ার হাত ধরে টেনে তুলল, দুজন মিলে চলল কর্মরতা মহিলাদের দিকে। খুব সম্ভব ওদের কফি খাওয়ার কথা বলতে। এদিকে ঘাসের উপর একটা চাদর বিছিয়ে চামড়ার ব্যাগ থেকে। খাবার বের করছে মারগ্রিয়েট, ডজন দেড়েক কাগজের তৈরি কাপ আর একটা মস্তবড় ফাস্কও বেরোল ব্যাগ থেকে।
রানার পেছন থেকে মৃদু একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল পিস্তলের দিকে হাত বাড়াবেন না, মেজর মাসুদ রানা। ওটা ছোঁয়ার আগেই মারা পড়বেন।
লোকটা যে-ই হোক, তার কথা বিশ্বাস করল রানা বিনা দ্বিধায়। পিস্তল তুলে নেয়ার চেষ্টা করল না সে।
ঘুরে দাঁড়ান। ধীরে ধীরে।
খুব ধীরে ঘুরে দাড়াঁল রানা। লোকটার আদেশে এমন একটা কিছু আছে যে পরিষ্কার বোঝা যায়, অক্ষরে অক্ষরে পালিত না হলে ঘটে যাবে ভয়ঙ্কর কিছু।
তিন পা সরে যান বামদিকে।
এতক্ষণে গলার স্বরটা চিনে ফেলেছে রানা। সামনে দেখতে পেল না। কাউকে। তিন পা সরে গেল সে বামদিকে।
মাচার ওপাশে জমা করে রাখা খড়ের কাছে নড়াচড়ার আভাস পাওয়া গেল। দুজন লোক বেরিয়ে এল আড়াল থেকে। প্রথম জন রেভারেন্ড ডক্টর নিকোলাস রজার, দ্বিতীয়জন ব্যালিনোভা নাইট-কাবের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার স্যামুয়েল, যার চেহারাটা দেখেই বিষাক্ত সাপের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল রানার। ভক্টর রজারের হাত খালি, কিন্তু স্যামুয়েলের হাতের বিশাল মাউষার তিনটে পিস্তলের পিলে চমকে দেয়ার পক্ষে যথেষ্ট। পলকহীন সাপের চোখ স্থির হয়ে রয়েছে রানার চোখের উপর। ওর চোখের উজ্জ্বলতা সাবধান। করে দিল রানাকে, সামান্যতম কোন ছুতো পেলেই গুলি করবে স্যামুয়েল, ছটফট করছে সে প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্যে। বিশাল মাউযারের মুখে লাগানো লম্বা নলটা জানিয়ে দিচ্ছে যত খুশি গুলি করতে পারে স্যামুয়েল, কেউ টের পাবে না কিছু।
বিচ্ছিরি, পচা গরম ওখানটায়, বলল নিকোলাস রজার। দম আটকে আসছিল একেবারে! তার ওপর চুলকানি পোকার ডিপো হয়েছে ওই খড়ের। গাদা। রানার দিকে চেয়ে নিষ্পাপ মধুর হাসি হাসল। অপ্রত্যাশিত সব জায়গায় দেখা যাচ্ছে আপনাকে আজকাল, মেজর মাসুদ রানা।