দেখতে পেলেই যদি ছুটে এসে গলা জড়িয়ে ধরে, সেই ভয়ে একটা রিভলভিং পিকচার-পোস্টকার্ড স্ট্যান্ডের আড়ালে দাঁড়াল রানা, অপেক্ষা করছে। ওদের পার হয়ে যাওয়ার।
কিন্তু পার হলো না ওরা। দরজা ছাড়িয়ে কয়েক কদম গিয়েই কাঁচের ওপাশ থেকে মারিয়াকে দেখতে পেল ইরিন, দেখেই থমকে দাঁড়াল, মারগ্রিয়েটকে কি যেন বলল, মারগ্রিয়েট মাথা নাড়তেই ওর বিপুলায়তন হাত ধরে টানাটানি শুরু করল। অনিচ্ছাসত্ত্বেও দোকানে ঢুকতে হলো মারগ্রিয়েটকে, দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে পড়ল সে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির গাভীর্য। নিয়ে, একছুটে মারিয়ার কাছে গিয়ে ওর হাত চেপে ধরল ইরিন।
আমি তোমাকে চিনি, খুশি উপচে পড়ছে ইরিনের কণ্ঠস্বরে। আমি চিনি। তোমাকে।
ইরিনের দিকে ফিরে মৃদু হাসল মারিয়া। আমিও তোমাকে চিনি। কেমন আছ, ইরিন?
আর এ হচ্ছে মারগ্রিয়েট। বিপুল চেহারার মারগ্রিয়েটকে দেখে বোঝা যাচ্ছে এসব পছন্দ হচ্ছে না ওর মোটেও। ওর দিকে ফিরে ইরিন বলল, মারগ্রিয়েট, এ আমার বন্ধু, মারিয়া।
ভ্যাংচানোর মত একটা মুখভঙ্গি করল মারগ্রিয়েট মারিয়ার প্রতি, আঙুল দিয়ে ইশারা করল ইরিনকে বেরিয়ে আসবার জন্যে। কিন্তু এসবের তোয়াক্কা করল না ইরিন। মুগ্ধদৃষ্টিতে মারিয়ার মুখের দিকে চেয়ে বলল, মেজর মাসুদ রানা আমার বন্ধু।
আমি জানি সেটা, মদ হেসে বলল মারিয়া।
তুমি খুব সুন্দর। তুমি আমার বন্ধু হবে না, মারিয়া?
নিশ্চয়ই। কেন হব না?
খুশিতে হাততালি দিল ইরিন। বলল, আমার আরও অনেক বন্ধু আছে। হাইলারে। দেখবে? এদিকে এসো, দেখাচ্ছি। হাত ধরে প্রায় টেনে দরজার। কাছে নিয়ে এল ইরিন মারিয়াকে, আঙুল তুলে দুরের গোলাবাড়ির পাশে কর্মরত মহিলাদের দিকে দেখাল, ওই..ই যে, দেখতে পাচ্ছ? উ…ই যে।
ওরা তোমার বন্ধু বুঝি? খুব ভাল।
সত্যিই খুব ভাল, মারগ্রিয়েটের হাতের ব্যাগের দিকে চাইল ইরিন। আমরা যখন আসি, ওদের জন্যে খাবার নিয়ে আসি, কফি নিয়ে আসি। তুমিও চলো, মারিয়া। খুব মজা হবে! মারিয়াকে ইতস্তত করতে দেখে অবাক হয়ে চাইল ওর মুখের দিকে। বলল, এই না বললে, তুমি আমার বন্ধু?
তা তো নিশ্চয়ই, কিন্তু…
কোন কিন্তু নয়। চলো না, আবদারের সুরে বলল ইরিন। খুব ভাল ওরা। সত্যিই খুব ভাল। সবসময় খুশি হয় আমাদের দেখলে। গান শোনায়। কোন কোনদিন হে ডান্স দেখায়। দারুণ! খুব ভাল লাগবে তোমার। মারিয়ার হাত ধরে বাচ্চা মেয়ের মত টানতে শুরু করল ইরিন।
হে ডান্স কি?
খড়ের নাচ। দেখোনি কোনদিন? অপূর্ব! প্লীজ, চলো আমাদের সাথে। আমার কথা রাখবে না তুমি, মারিয়া? এত করে বলছি… কাঁদোকাঁদো হয়ে এল ইরিনের গলা। মুখ দেখে মনে হচ্ছে ফুঁপিয়ে উঠবে এখুনি।
আচ্ছা, আচ্ছা, ঠিক আছে, বাবা, হাসতে হাসতে বলল মারিয়া। এত করে বলছ, তাই যাচ্ছি, ইরিন। কিন্তু আগে থেকে বলে রাখছি, বেশিক্ষণ কিন্তু। থাকতে পারব না।
সত্যিই, খুব ভাল তুমি, মারিয়া। মারিয়ার হাতটা বুকের কাছে চেপে ধরে খুশি প্রকাশ করল ইরিন। আমি তোমাকে ভালবাসি
দোকান থেকে বেরিয়ে গেল তিনজন। দুমিনিট পিকচার পোস্টকার্ড ঘাটাঘাটি করে আলগোছে বেরিয়ে পড়ল রানাও। প্রায় চল্লিশ গজ সামনে একটা সাইড লেন, ধরে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখল সে ওদের। পা বাড়াল। সামনে। সাইড লেনের মাথায় এসে দেখল, মাঠের মধ্যে দিয়ে রওনা হয়েছে। তিনজন গোলাবাড়ির দিকে। ছয়-সাতশো গজ দুরে ছোট ছোট দেখাচ্ছে কর্মরত মহিলাদের। দূর থেকে গোলাবাড়িটাকে খুবই প্রাচীন আর নিঃসঙ্গ বলে। মনে হচ্ছে। মন খুলে উঁচু গলায় কথা বলছে ইরিন, খুশির চোটে মাঝে মাঝে লাফাচ্ছে ঠিক ছাগলের বাচ্চার মত, স্থির থাকতে পারছে না।
ওরা একটা ঢিবির আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যেতেই পেছন পেছন চলল রানা। টিবির পরেই ময়দানের সীমা চিহ্নিত করবার জন্যে ফুটপাঁচেক উঁচু ঝোপের বেড়া, লম্বালম্বি চলে গেছে সামনের দিকে। ঝোঁপের ওপাশ দিয়ে কোমর থেকে উপরের অংশ সামনের দিকে বাকিয়ে চলল রানা ওদের তিনজনের গজ। তিরিশেক পেছনে। এইভাবে বাকা হয়ে ছয়শো গজ যেতেই কোমর ব্যথা হয়ে গেল ওর। উঁকি দিয়ে দেখল, গোলাবাড়ির পশ্চিম দিকে সূর্যের থেকে আড়াল হয়ে বসল ওরা তিনজন। রঙবেরঙের পোশাক পরা মহিলারা কাজ করছে বাড়িটার উত্তরপশ্চিম কোণে। আরও কিছুদূর এগিয়ে গোলাবাড়িটাকে আড়াল হিসেবে ব্যবহার করে এক দৌড়ে চলে এল রানা একটা সাইড ডোরের পাশে, আস্তে করে দরজা খুলে ঢুকে পড়ল ভেতরে।
দূর থেকে যতটা মনে হয়েছিল, কাছ থেকে তার চেয়ে অনেক বেশি প্রাচীন মনে হলো রানার কাছে গোলাবাড়িটা। এটার বয়স অন্তত একশো বছর তো হবেই। মেরামতের অভাবে একেবারে জরাজীর্ণ অবস্থা। এবড়োখেবড়ো কাঠের তৈরি দেয়ালের কোন কোন জায়গায় দুইঞ্চির বেশি ফাঁক।
মাচায় ওঠার সিড়টার দিকে চেয়ে পুরো আধমিনিট লেগে গেল রানার। উপরে উঠবে কি উঠবে না সেই সিদ্ধান্ত নিতে। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, জায়গায় জায়গায় পচে গেছে মাচার কাঠ, ঘুণ ধরেছে কয়েকটা কাঠে। ওর উপর পা দিলেই মড়াৎ করে ভেঙে পড়বে নিচে। সিডিটার অবস্থাও তথৈবচ। কিন্তু তবু উপরে ওঠাই স্থির করল সে। কারণ ওখান থেকেই সবার উপর নজর রাখা সহজ। নিচে দাঁড়িয়ে থাকলে যে কোন মুহূর্তে যে কোন লোকের ভেতরে ঢুকে পড়বার সম্ভবনা তো থাকছেই, তার উপর কাঠের ফাঁক দিয়ে বাইরের দিকে উঁকি দিতে গিয়ে দুই ইঞ্চি দরে ভেতর দিকে উঁকিদানরত একজোড়া চোখ। দেখতে পাবে না তার কি নিশ্চয়তা? কাজেই অতি সন্তর্পণে, সামান্যতম আওয়াজও না করে পা টিপে উঠে গেল সে মাচার উপর।