শহরতলি ছাড়িয়ে প্রথম যে গ্রামটা পেল, সোজা গিয়ে তার পোস্ট। অফিসের সামনে ট্যাক্সি থেকে নামল রানা। টেলিফোন বুদে ঢুকে ডায়াল করল। সোহানার হোটেলে। জানা গেল, কিছুক্ষণ আগেই রানার মেসেজ পেয়েছে সোহানা কর্নেল ডি গোল্ডের মাধ্যমে, দরজায় তালা মেরে বসে আছে এখন পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায়।
আমি খুব তাড়াহুড়োর মধ্যে রয়েছি সাহানা। তোমাকে কতকগুলো। কথা বলে যাব আমি এখন গড়গড় করে। এসব কথা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু। ধীরেসুস্থে যে এসবের মানে ব্যাখ্যা করব, তার সময় নেই। তোমার তো বাংলা শট হ্যাঁন্ড জানা আছে, লিখে নাও আমার বাণী–আমার বিশ্বাস, আগাগোড়া বারুদশেক পড়লেই সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে তোমার কাছে। গেট রেডি।
এক সেকেন্ড, খুব সম্ভব কাগজ পেন্সিল নিয়ে তৈরি হওয়ার সময় চাইল। সোহানা, ঠিক তিন সেকেন্ড পর বলল, বললো, আমি রেডি।
গড়গড় করে একনাগাড়ে পাঁচ মিনিট কথা বলে থামল রানা। কোনরকম সম্ভাষণ বিনিময় না করেই ঝটাং করে রিসিভার নামিয়ে রেখে একলাফে গিয়ে উঠল গাড়ির ড্রাইভিং সীটে। ছুটল আবার। হাইলারের বাঁধের কাছে এসে গাড়ির গতি কমিয়ে স্বাভাবিকে নিয়ে এল রানা, কয়েক মিনিট পর যেখান থেকে। সাইকেল চুরি করেছিল সেই কারপার্কে এসে থামাল সে ট্যাক্সিটা। ইতিমধ্যেই অনেক গাড়ির ভিড় জমে গেছে। ভালই–ভাবল রানা মনে মনে, ট্যুরিস্টদের। ভিড়ে মিশে যেতে কোন অসুবিধে হবে না।
অ্যামস্টার্ডাম থেকে রওনা হওয়ার সময়ই লক্ষ করেছিল রানা, পরিষ্কার। হয়ে আসছে আকাশটা, হাইলারে পৌঁছে দেখা গেল গত রাতে এত যে বৃষ্টি হয়েছে সেটা আর বিশ্বাস হতে চায় না আকাশের দিকে চাইলে। ডাচ ওয়েদারকে এইজন্যেই বোধ হয় আনপ্রেডিকটেবল বলে। সাদা রঙের, ছোটখাট এক-আধ টুকরো মেঘ ভাসছে আকাশে, বাকি সব ফরসা। কড়া রোদ বাষ্প টেনে তুলছে মাঠের বুক থেকে।
কোট খুলে হাতের উপর ভাজ করে রাখল রানা, সাইলের ফিট করা। পিস্তলটা কোটের পকেটে, পকেটটা এমনভাবে রানার দিকে ফেরানো যে। প্রয়োজনের সময় আধসেকেন্ডের বেশি সময় লাগবে না ওটা বের করে আনতে। সহজ ভঙ্গিতে সেই বাড়িটার দিকে হাঁটতে শুরু করল সে। বাড়িটার। কাছে এসে দেখল রানা, দরজা দুপাট খোলা, ভেতরে ট্র্যাডিশনাল হাইলার কস্টিউম পরা মহিলা দেখতে পেল। পঞ্চাশ গজ দূরে একটা দোকানে দাঁড়িয়ে এটা ওটা ঘাটাঘাটি করল কিছুক্ষণ, তারপর একটা সন্ত্রাস কিনল। ওই বাড়ির দরজা দিয়ে লোকজনকে ঢুকতে বেরোতে দেখা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। টুকিটাকি, আরও কিছু জিনিস কিনবার ছলে মিনিট দশেক পার করল রানা এ-দোকান ও দোকানে। আসলে খুজছে মারিয়াকে। ক্রমে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে সে। দুজন লোককে দুটো বাক্স মাথায় করে বেরিয়ে আসতে দেখল রানা বাড়িটা থেকে, এক চাকার ঠেলাগাড়িতে ওগুলো তুলে ঠেলে নিয়ে চলে গেল ওরা বন্দরের দিকে। বোঝা যাচ্ছে, ওটা একটা কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠান। কি ধরনের শিল্প চলছে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, কিন্তু সন্দেহজনক কিছু যে নয় সেটা বোঝা যায় ওদের খোলামেলা ভাব দেখে। দুজন ট্যুরিস্টকে হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানাতে দেখল রানা দরজার একপাশে দাঁড়ানো একজন লোককে। ভেতরে ঢুকে ওদের কাজ দেখার অনুরোধ করল, টুরিস্ট দুজন গেল ভেতরে, খানিক পরে আবার বেরিয়েও এল, চোখমুখে মুগ্ধ বিস্ময়ের ভাব। রাস্তার দুপাশের দোকানগুলোয় মারিয়াকে খুজতে খুজতে অনেক কাছে চলে এল রানা ওই। বাড়িটার। ভয় হলো, আমন্ত্রণ পেয়ে মারিয়াও ঢোকেনি তো ওই বাড়ির। ভেতর? জোর করে আশঙ্কাটা দূর করে দিল রানা মন থেকে। ও যে রকম মেয়ে, ঠিক যা বলা হয়েছে সেটা অমান্য করে বাড়াবাড়ি করবে না কিছুতেই। তবু ওকে খুঁজে পেতে যত দেরি হচ্ছে, ততই অস্থির হয়ে উঠছে রানা ভেতর ভেতর।
বাড়িটার উত্তরে বিস্তীর্ণ এক খড়ের মাঠ। বহু দূরে ট্র্যাডিশনাল পোশাক পরা কয়েকজন মহিলাকে দেখা গেল, বিশাল কাঁটাচামচের মত দেখতে হে ফর্ক দিয়ে খড় আলগা করছে শুকোবার জন্যে। সংক্ষিপ্তভাবে চিন্তা করল রানা, এখানকার পুরুষ লোকগুলো করে কি? বেশির ভাগ কাজই দেখা যাচ্ছে করছে মহিলারা। সুখেই আছে মনে হয় ব্যাটারা।
আর কিছুদূর এগিয়েই মারিয়ার পিঠ আর মাথা দেখতে পেল রানা। মুহূর্তে দুর্ভাবনার মেঘ কেটে গিয়ে ঝলমল করে উঠল রানার মনটা খুশিতে। মস্ত একটা ভার নেমে গেল যেন ওর বুকের উপর থেকে। ঠিক যেমন নির্দেশ দিয়েছিল তেমনি একটা সুবিধেজনক জায়গা বেছে নিয়েছে মারিয়া। মস্তবড় একটা সুভ্যেনির-স্টোরে লোকজনের ভিড়ে মিশে এটা ওটা দেখছে নেড়েচেড়ে, কিন্তু সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে ওর সেই কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠানের দরজার দিকে। রানাকে দেখতে পেল না। ভেতরে ঢুকতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল রানা, মুহূর্তে সজাগ, সতর্ক হয়ে গেল ওর পঞ্চ ইন্দ্রিয়। এখানে কি করছে মেয়েটা? চট করে দরজার আড়ালে সরে গিয়ে চোখ রাখল রানা রাস্তার দিকে।
ইরিন আর মারগ্রিয়েট এগিয়ে আসছে এইদিকে। সীভলেস গোলাপী একটা ফ্রক পরেছে ইরিন, হাতে লম্বা গ্লাভস, বাচ্চা মেয়ের মত স্কিপিঙের। ভঙ্গিতে হাটছে, কালো চুল লাফাচ্ছে ঘাড়ের উপর, মুখে শিশুর পবিত্র হাসি। তার ঠিক পেছনেই মারগ্রিয়েট, পুতুলের পোশাক পরা হিমালয় পর্বত, হাতে ঝুলছে বড়সড় একটা চামড়ার ব্যাগ।