ঠিক বুঝতে পারলাম না, আরেকটু বিশদ বিশ্লেষণের অনুরোধ কর্নেলের কণ্ঠে।
মৃত্যুর মুখে পাঠিয়েছি হয়তো মারিয়াকে।
মারিয়া?
আপনাকে বলা হয়নি, আমার সাথে আরও দূজন মেয়ে এসেছে ইন্টারপোল থেকে। ওদের একজনের নাম মারিয়া। আরেকজন সোহানা চৌধুরী। হোটেল পেছন থেকে মাগেনহেলারের ডাক শুনে থেমে দাঁড়াল দুজনই। সাদা একটা ভ্যানিটিব্যাগ হাতে খলিয়ে গম্ভীর মুখে সামনে এসে দাঁড়াল, ইন্সপেক্টর। রানা জিজ্ঞেস করল, ব্যাগটা বিট্রিক্স শেরম্যানের? মাগেনথেলারকে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিতে দেখে বলল, ওটা আমাকে দিন, প্লীজ।
ভুরু কুঁচকে মাথা নাড়ল মাগেনথেলার। এটা দেয়া যাবে না। খুনের কেসে..
দিয়ে দাও, মাগেনথেলার, বলল কলে। চাইছে যখন, নিশ্চয়ই দরকার আছে।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও ব্যাগটা রানার হাতে তুলে দিল মাগেনথেলার। ওটা হাতে নিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করল রানা। বলল, যা বলছিলাম। হোটেল গাযার তিনশো চৌত্রিশ নম্বর কামরায় রয়েছে সোহানা। দয়া করে। আমার হয়ে একটা টেলিফোন করবেন ওকে, কনেল। মন্তু বিপদে আছে ও। ওকে বলবেন, যেন দরজায় চাবি লাগিয়ে ঘরের মধ্যেই বসে থাকে যতক্ষণ না। আমার তরফ থেকে কোন মেসেজ পায়। বলবেন, আমি ছাড়া আর কেউ যদি টেলিফোন করে, কিংবা চিঠি দেয়, বক্তব্যের মধ্যে যদি মাদাগাস্কার শব্দটা না থাকে তাহলে সেসবের যেন বিন্দুমাত্র মূল্য না দেয়। ব্যাপারটা অত্যন্ত জরুরী-ব্যক্তিগতভাবে আপনি নিজে যদি খবরটা ওকে জানান, তাহলে সবচেয়ে ভাল হয়।
অলরাইট, মাথা দোলাল কর্নেল। আমি নিজেই ফোন করব।
কর্নেলের গাড়ির দিকে ইঙ্গিত করল রানা। আপনার রেডিও-টেলিফোনে হাইলারের পুলিসের সাথে কথা বলা যাবে না?
যাবে। মার্সিডিজের দিকে এগোল ডি গোল্ড। এক্ষুণি দরকার?
এই মুহূর্তে।
ড্রাইভারকে হাইলার-পুলিসের সাথে কন্ট্যাক্ট করতে বলে সোজা হয়ে দাঁড়াল কর্নেল। রানা বলল, মারিয়াকে খুঁজে বের করতে হবে। মারিয়া ডুক্লজ, পাঁচ ফুট দুই, লম্বা সোনালি চুল, নীল চোখ, দেখতে খুবই ভাল, স্কার্ট আর নেভি র রঙের জ্যাকেট, সাদা রাউজ। হ্যাঁন্ডব্যাগটাও সাদা। ওকে পাওয়া যাবে
এক সেকেন্ড। হাত তুলে রানাকে থামিয়ে দিল কর্নেল ডি গোল্ড। ড্রাইভারের দিকে ঝুঁকে দুই সেকেন্ড পর সোজা হয়ে চাইল রানার চোখের। দিকে। দুঃখিত। হাইলারের লাইনটা ডেড হয়ে আছে, মেজর রানা। আপনি। যেদিকে পা বাড়াচ্ছেন সেদিকেই ডেথ। লক্ষণটা খুব ভাল ঠেকছে না আমার। কাছে, মেজর।
ঠিক আছে, দুপুরের দিকে টেলিফোন করব আমি আপনাকে, বলেই ট্যাক্সির দিকে এগোল রানা।
আমিও যাচ্ছি আপনার সাথে, বলল মাগেনথেলার।
নানান কাজে হাত জোড় আছে আপনার এখানেই। তাছাড়া আমি যেখানে যাচ্ছি সেখানে পুলিসের লোকের কোন সাহায্য দরকার পড়বে না। আমার।
তার মানে আইনের বেড়া ডিঙোতে যাচ্ছেন আপনি, অনুযোগের সুরে বলল মাগেনথেলার।
এখনই আমি আইনের বাইরে রয়েছি, মাগেনথেলার। ইসমাইল আহমেদ মৃত। বিট্রিক্স শেরম্যান মৃত। এতক্ষণে হয়তো মারিয়া ডকুজও মারা গেছে। আইন কি রক্ষা করতে পেরেছে ওদের? যারা আইনের বাইরে চলে তাদের সাথে মোলাকাত করতে হলে এপারে বসে থাকলে চলবে না, বেড়া ডিঙিয়ে আমাকেও যেতে হবে ওপারে।
সেক্ষেত্রে আমার মনে হয় আপনার পিস্তলটা আমাদের কেড়ে নেয়া। উচিত, নরম গলায় বলল ইন্সপেক্টর। এই মুহূর্তে।
ঠিক বলেছেন, টিটকারির সুরে বলল রানা। ওটা কেড়ে নিয়ে বরং একটা বাইবেল তুলে দিন আমার হাতে। বাইবেলের বাণী শুনিয়ে ঠিক সুপথে নিয়ে আসব আমি ওদেরকে। তেতো হাসি হাসল রানা। আগে আমাকে খুন। করুন, ইন্সপেক্টর, তারপর পিস্তলটা দখলে পাবেন।
কর্নেল বলল, আপনার কাছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে, মেজর মাসুদ রানা, যেগুলো আপনি গোপন রাখছেন আমাদের কাছ থেকে।
আমার উত্তর হচ্ছে আছে এবং রাখছি।
কাজটা কিন্তু ভদ্রতা এবং আইনের বাইরে চলে যাচ্ছে। ঠিক উচিত হচ্ছে কি?
গাড়িতে উঠে বসল রানা। উচিত হচ্ছে কি হচ্ছে না তার বিচার করতে পারবেন পরে–এখন না। কিন্তু ভদ্রতা বা আইন সম্পর্কে এটুকু বলতে পারি–আপাতত কেয়ার না করাই উচিত বলে মনে করছি।
এঞ্জিন স্টার্ট দিয়েই আড়চোখে লক্ষ করল রানা, দ্রুতপায়ে এগিয়ে আসতে যাচ্ছিল ইন্সপেক্টর মাগেনথেলার, একটা হাত তুলে বারণ করল ওকে কর্নেল ভ্যান ডি গোন্ড। কানে এল, কর্নেল বলছে, যেতে দাও ওকে, ইন্সপেক্টর, যেতে দাও।
.
০৭.
পাগলের মত ছুটল রানা। যে স্পীডে গাড়ি চালাল, তাতে অ্যামস্টার্ডাম থেকে হাইলার পর্যন্ত পৌঁছুতে পৌঁছুতে অন্তত আধড়জন অ্যাকসিডেন্ট করবার কথা, প্রত্যেকটাই সিরিয়াস, কিন্তু ফ্যাশিং লাইট আর তীক্ষ্ণ সাইরেন যাদুমন্ত্রের মত। পরিষ্কার করে দিল ওর সামনের রাস্তা। সামনের প্রত্যেকটা গাড়িই গতিবেগ কমিয়ে একপাশে সরে পথ ছেড়ে দিল রানার।
অন্য কোন গাড়ি পেলে খুশি হত রানা, কিংবা বাস যদি একশো মাইল বেগে চলত তাহলে তাতে করে যেতে পারলে আরও খুশি হত। কারণ আরও দৃষ্টি আকর্ষণ না করে সাধারণ এক টুরিস্ট হিসেবে যেতে চায় সে হাইলারে, লাল-হলুদ ডোরাকাটা ট্যাক্সি চালিয়ে ওখানে পৌঁছুলে চোখে পড়ে যাবে। হয়তো অনেকের। কিন্তু দ্রুততার খাতিরে অন্যান্য সুবিধে বিসর্জন দিতে হলো ওকে।