কয়েক পা এগিয়ে গলিখে এসেই পাথরের মূর্তির মত স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। গেল রানা। ভলেনহোভেন কোম্পানীর হয়েস্টিং বীম থেকে বলিছে দেহটা। গলায় রশি বাধা। বাতাসে দুলছে, অল্প অল্প। চোখ ফিরিয়ে নিল রানা। সত্যিই তাকিয়ে থাকা যায় না। পাশে এসে দাঁড়াল ডি গোল্ড, আর একবার ঝুলন্ত লাশটার দিকে চেয়ে কাঁধ ছোট করে শিউরে ওঠার ভঙ্গি করল।
লাশটা নামানোর ব্যবস্থা করছেন না কেন?নিজের গলার স্বর কেমন যেন বিসদৃশ ঠেকল রানার নিজের কানেই। মনে হলো, সে নয়, দূর থেকে আর কেউ বলল কথাটা। হাঁটতে শুরু করল সে সামনের দিকে।
ডাক্তারের কাজ। গেছে একজন ওপরে। রানার সাথে সাথে এগোল। কনেল।
মাথা ঝাঁকাল রানা। অনেকটা আপনমনে বলল, খুব বেশিক্ষণ ধরে ঝুলছে বলে মনে হয় না। ঘণ্টাখানেক আগেও বেঁচে ছিল মেয়েটা। ওয়েরহাউজ খোলা হয় অনেক সকালে। এত লোকজনের কেউ দেখল না।
আজ তো শনিবার, বাধা দিয়ে বলল কর্নেল। শনিবার বন্ধ রাখে এরা কাজকর্ম।
আবার মাথা ঝাঁকাল রানা। চরকার বেগে চিন্তা চলছে ওর মাথার ভেতর। হঠাৎ একটা কথা মনে আসতেই থেমে গেল চরকা। মনে মনে আস্ত এক ডিগবাজি খেয়ে উঠল রানা। অনুভব করল দ্রুততর হয়ে গেছে ওর হার্টবিট। ভয়ের ধাক্কায় ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছে যেন সে। থমকে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরাল একটা।
বিট্রিক্সকে দিয়ে সোহানার কাছে টেলিফোন করাবার কি অর্থ? সোহানার মাধ্যমে কিছু একটা জানাতে চায় ওরা রানাকে। বিট্রিক্সের মেসেজের কোন অর্থ নেই ক্যাসটিল লিভেন বা ভলেনহোভেন কোম্পানী কোথাও আসলে যেতে বলেনি ওকে রানা। সোহানা আর মারিয়ার কাছে লিভেনের কথা বলেছিল সে অন্য উদ্দেশ্যে। গতরাতে সমুদ্রযাত্রা করতে গিয়ে যদি কোন কারণে ওর মৃত্যু ঘটে, তাহলে যেন ক্যাসটিল নামটা কর্নেল ডি গোন্ডের কানে ওঠে তারই নিশ্চয়তা বিধান করেছিল। কিন্তু বিট্রিক্সের মেসেজ আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন মনে হলেও ওই মেসেজের ভিত্তিতেই সোজা ভলেনহোভেন। কোম্পানীতে এসেছে সে ওর খোঁজে। ওকে দিয়ে এই মেসেজ দেয়া প্রয়োজনই মনে করত না ওরা, যদি ওরা মনে করত মারা গেছে রানা। তার মানে, ওরা জানে বেচে আছে রানা। কি করে জানল? হাইলারের ওই তিন প্রৌঢ়া মহিলা ছাড়া আর কারও সাথেই তো দেখা হয়নি রানার। হয় ওরা। জানিয়েছে, নয়তো অন্য আরও কোন উপায় রয়েছে ওদের রানার গতিবিধি টের পাওয়ার।
আচ্ছা, ধরা যাক, ওরা জানে বেঁচে আছে রানা। তাহলে বিট্রিক্সকে খুন করবার কি মানে দাঁড়ায়? অনেক কষ্ট স্বীকার করে রানাকে বুঝিয়েছে ওরা যে বেচে আছে বিট্রিক্স, পালিয়ে গেছে এথেন্সে, তারপর আবার ওকে হয়েস্টিং বীমের সাথে ঝুলিয়ে দেয়ার কি অর্থ? প্রশ্নটা মনে জাগবার সাথে সাথেই উত্তর পেয়ে গেল রানা। বিট্রিক্সকে খুন করা হয়েছে অনেক আগেই। খুব সম্ভব রাত। দুটোয় রানার মৃত্য সংবাদ পাওয়ার পরপরই ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে হয়েস্টিং বীমের সাথে। রানার বেচে থাকার সংবাদ যখন পেয়েছে ওরা, ততক্ষণে বেলা। উঠে গেছে, লাশটা তখন আর নামিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। কাজেই পানিটা ঘোলা করে তোলবার জন্যেই ফোন করানো হয়েছে সোহানার কাছে আর কাউকে দিয়ে। তাড়াহুড়োয় ছোট দুটো ভুল করেছে ওরা খেয়ালই করেনি যে বিট্রিক্সের পক্ষে সোহানা এবং মারিয়া কোন্ হোটেলে উঠেছে সেটা জানা সম্ভব। ছিল না। দ্বিতীয়ত, ওদের জানা আছে যে সোহানা বা মারিয়া কারও সাথে, কখনও কোন কথা হয়নি বিট্রিক্সের, ফলে বিটেক্সের পরিচয়ে যে কেউ একজন ফোন করলেই চলে কিন্তু কথাটা যে রানারও জানা আছে, সেটা ভুলে গিয়েছিল ওরা প্ল্যান তৈরি করবার সময়।
যাই হোক, আসল কথা, সম্মুখ সমরে চ্যালেঞ্জ দিয়েছে ওরা এবার রানাকে। জানিয়ে দিয়েছে, আর গোপনীয়তার প্রয়োজন নেই, মরিয়া হয়ে শেষ ছোবলের জন্যে প্রস্তুত হয়েছে গোক্ষুর। অর্থাৎ, ভীমরুলের চাকে সত্যিই ঢিল লেগেছে এবার, বিরক্তির শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে ওরা–এবার মাসুদ রানা, ঠ্যালা সামলাও! দেখা যাক কার পাঞ্জায় কত জোর।
রশিটা ঝুলছে কেবল, লাশটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। ভলেনহোভেন কোম্পানীর সামনে এসে মুখ খুলল কর্নেল ডি গোন্ড। আপনার চেহারার এই হাল হলো কি করে, মেজর রানা?
প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রানা বলল, ডাক্তারকে একটু ডেকে পাঠানো যাবে?
কেন যাবে না, একশোবার যাবে। একজন সেন্ট্রিকে হুকুম দিতেই সে গিয়ে ডেকে নিয়ে এল ডাক্তারকে।
অল্পবয়সী ছোকরা ডাক্তার। ফ্যাকাসে চেহারা। রানার সন্দেহ হলো, এর স্বাভাবিক চেহারা হয়তো এতটা ফ্যাকাসে না, হত্যার নির্মমতা উপলব্ধি করেই হয়তো এই হাল হয়েছে।
বেশ অনেকক্ষণ আগেই মারা গেছে মেয়েটা, তাই না? কর্কশ কণ্ঠে প্রশ্ন। করুল রানা।
ভুরু কুঁচকে মাথা ঝাঁকাল ডাক্তার। শিওর হয়ে বলা যাচ্ছে নাঃঘণটা পাঁচেক তো হবেই।
ধন্যবাদ।বলেই ঘুরে গলিমুখের দিকে হাঁটতে শুরু করল রানা। সাথে সাথে আসছে ডি গোল্ড। চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে অনেক প্রশ্ন ভিড় করে। রয়েছে, কর্নেলের মনে, কিন্তু ঠিক কিভাবে শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছে না। বারবার সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চাইছে রানার মুখের দিকে। কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ। নেই রানার, নিচু গলায় বলল, আমার জন্যেই মারা পড়ল মেয়েটা। একটু থেমে বলল, হয়তো আরেকজনও মারা পড়তে যাচ্ছে আমারই ভুলের জন্যে।