পুলিশ হেডকোয়ার্টার।
অপারেটর, এক্ষুণি আমাকে কর্নেল ডি গোল্ডের কানেকশন দিন। জলদি! আমি কে সে প্রশ্ন অবান্তর। আর্জেন্ট। এই মুহূর্তে কথা বলতে চাই আমি। কর্নেলের সাথে। দুমিনিটের অস্বস্তিকর নীরবতা। গাড়িঘোড়া বাঁচিয়ে তুফান। বেগে ছুটছে রানা। ভিড় বাড়ছে ক্রমে। তারপর ভেসে এল অপারেটরের কণ্ঠস্বর।
কর্নেল ডি গোল্ড এখনও অফিসে আসেননি।
তাহলে তার বাসায় যোগাযোগ করুন। চেঁচিয়ে উঠল রানা। ইমিডিয়েট! আর্জেন্ট। ঠিক তিন মিনিটের মধ্যে ভেসে এল কর্নেলের গম্ভীর। গলা। কর্নেল, রানা বলছি।…হ্যাঁ, হ্যাঁ। বিট্রিক্স শেরম্যানের ব্যাপারে। আমার মনে হয় মারাত্মক বিপদের মধ্যে আছে মেয়েটা।… সেসব পরে শুনবেন। এক্ষুণি আপনার অ্যাকশন নেয়া দরকার।…ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানীতে। আমার বিশ্বাস ওখানেই পাওয়া যাবে ওকে। জলদি! ফর গড়স সেক, জলদি করুন। ম্যানিয়াকের পাল্লায় পড়েছে মেয়েটা।
কান থেকে এয়ারফোন খসিয়ে রেডিওর সুইচ অফ করে দিল রানা। মন দিল, গাড়ি চালনায়। বারবার ধিক্কার আসছে ওর নিজের উপর, বুঝেও বুঝতে চাইছে না রানা দুর্দান্ত এক ক্রিমিনাল জিনিয়াসের বিরুদ্ধে কাজ করছে সে, বুদ্ধির চালে হেরে গিয়ে ক্ষোভ করবার কিছুই নেই, ও নিজে যে বেঁচে আছে তাই যথেষ্ট। লোকটার চিন্তা-ভাবনা বা তৎপরতার ব্যাপারে আগে থেকে কিছু আন্দাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে ওর পক্ষে–কারণ কেবল জিনিয়াস হলে এক কথা ছিল, তার সাথে যুক্ত হয়েছে ভয়ানক এক সাইকোপ্যাথ। ইসমাইল আহমেদকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়েছিল বিট্রিক্স, তাতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই, কিন্তু সেটা ছিল হয় ইসমাইল নয় হেনরী–যে-কোন। একজনকে বেছে নেয়ার সিদ্ধান্ত! ভাইয়ের প্রাণের বিনিময়ে এই কাজটা করতে হয়েছিল বিট্রিক্সকে। তাও বাধ্য হয়ে। রানার পেছনেও ওকে লাগাবার ইচ্ছে ছিল ওদের, শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠানো হয়েছিল ওকে হোটেল কার্লটনে। কিন্তু যখন দেখা গেল, উল্টে রানাই লেগে গেছে ওর পেছনে, অন্ধকার থেকে টান। দিয়ে ওকে দিবালোকে নিয়ে আসবার চেষ্টা করছে, ঠিক তখনি অ্যাসেট না। হয়ে লাইয়াবিলিটি হয়ে পড়ল বিট্রিক্স ওদের কাছে।
কিন্তু ঝট করে ওকে খুন করে ফেলবার সাহস হলো না ওদের। ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছে এখন ব্যাপারটা রানার কাছে। সরাসরি বিট্রিক্সকে খতম করে দেয়ার সাহস হয়নি ওদের, তার কারণ ওদের জানা আছে যে মুহূর্তে ওরা বিট্রিক্সকে খুন করবে, রানা বুঝে নেবে যে ওর আসল উদ্দেশ্য সফল হবার নয়, এবং যেটা মনপ্রাণ থেকে চায়নি সেই কাজটা করতে হবে। তখন তাকে–অর্থাৎ সোজা পুলিসের কাছে গিয়ে যা জানে খুলে বলবে সব। সেটা ওরা চায়নি। কারণ যদিও পুলিসের কাছে গেলে রানার আসল উদ্দেশ্যটা। বিফল হয়ে যাচ্ছে, রানার কাছে যতটুকু তথ্য আছে সেটুকুই ওদের আগামী। কয়েক মাস, এমন কি কয়েক বছরের জন্যে পঙ্গু করে দেয়ার পক্ষে যথেষ্ট। ইচ্ছে করলে যে কোন মুহূর্তে চুরমার করে দিতে পারে রানা ওদের সংগঠন। এজন্যেই ব্যালিনোভা নাইটক্লাবে অভিনয় করানো হয়েছিল গুডবডি আর স্যামুয়েলকে দিয়ে। এতই নিখুঁত অভিনয় করেছে ওরা, যে সত্যি বিট্রিক্স আর হেনরী পালিয়ে গেছে, নাকি ওদের নামে আর দুজনকে পাঠানো হয়েছে এথেন্সে, ভালমত তলিয়ে দেখবার কথা মনেই আসেনি রানার। আজ সকালে সোহানার সাথে যখন কথা বলেছে, মেয়েটার কানের উপর যে পিস্তল ধরা ছিল। তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বিট্রিক্সকে বাঁচিয়ে রাখবার আর কোন মানেই নেই এখন। শত্রুপক্ষের সাথে হাত মিলিয়েছে মেয়েটা। এখন যখন রানার তরফ থেকে ভয়ের কোন কারণ নেই, ওদের ধারণা, রাত দুটোর সময়ে বার্জ-বন্দরের সাগরতলে চিরনিদ্রায় ঢলে পড়েছে মাসুদ রানা, তখন বিট্রিক্সকে নিয়ে যা খুশি তাই করতে। বাধবে না ওদের। সূত্র ধরে ধরে এগিয়ে সবই বুঝতে পারল রানা–তবে দেরিতে। অনেক দেরি হয়ে গেছে ওর, পরিষ্কার বুঝতে পারছে রানা, মেয়েটাকে রক্ষা করবার আর কোন পথ নেই।
শহরের মধ্যে দিয়ে আশ্চর্য দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলল রানা পাগলের মত গাড়ি হাঁকিয়ে। অবশ্য একজন লোকও চাপা পড়ল না ওর গাড়ির নিচে, তবে। এজন্যে রানার যতটা কৃতিত্ব তার চেয়ে অনেক বেশি কৃতিত্ব এখানকার জনসাধারণের। রানার গাড়িটা দেখামাত্র পূর্বপুরুষদের অনুকরণে প্রকাণ্ড লাফ দিয়ে সরে যাচ্ছে সবাই রাস্তা থেকে। পুরানো শহরে চলে এল সে, ওয়ানওয়ে সরু রাস্তা ধরে ছুটল ওয়েরহাউজ অঞ্চলের দিকে। কাছাকাছি গিয়েই থামতে হলো রানাকে। সামনে পুলিস ব্যারিকেড। রাস্তা বন্ধ। একটা জীপ দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার একপাশে, জনাকয়েক অটোমেটিক রাইফেলধারী টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির মত। জোরে ব্রেক চেপে স্কিড করে থেমে গেল গাড়ি, লাফিয়ে বেরোল রানা। একজন পুলিস এগিয়ে এল কয়েক পা।
রাস্তা বন্ধ, স্যার। পুলিস ব্যারিকেড।
হারি মুরা। নিজেদের গাড়িটাও চিনতে পারছ না, হাদারাম! বিরক্ত কণ্ঠে বলল রানা। রাস্তা ছাড়ো, যেতে দাও আমাকে।
কাউকেই যেতে দেয়া হচ্ছে না এই রাস্তায়। রাস্তা বন্ধ। অটল গাম্ভীর্যের সাথে বলল কনস্টেবল।
ঠিক আছে, ছেড়ে দাও ওকে। আমাদের লোক। কর্নেলের কণ্ঠস্বর শুনে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল রানা, ভলেনহোভেন অ্যান্ড কোম্পানীতে যাওয়ার গলিমুখ থেকে বেরিয়ে আসছে ডি গোল্ড। কর্নেলের চেহারা দেখেই ছোট্ট একটা লাফ দিল রানার কলজেটা দুঃসংবাদ আশঙ্কায়। কাছে এসে বলল ডি গোল্ড, দৃশ্যটার দিকে চাওয়া যায় না, মেজর মাসুদ রানা। বীভৎস!