নো ব্রেকফাস্ট মানে? নিজে নিশ্চয়ই ভরপেট নাশতা খেয়ে উঠেছ এইমাত্র?
অ্যাজ এ ম্যাটার অফ ফ্যাক্ট-ইয়েস। মুচকি হাসল রানা। একটা ট্যাক্সি নিয়ে সোজা হাইলার দ্বীপের দিকে রওনা হয়ে যাও।
হাইলার দ্বীপ মানে, যেখানে পাপেট তৈরি হয়?
হ্যাঁ। আমার সাথে দেখা হবে রাস্তায়। লাল-হলুদ স্ট্রাইপের একটা ট্যাক্সিতে থাকব আমি। আমাকে দেখলেই গাড়ি থামাতে বলবে ড্রাইভারকে। যত তাড়াতাড়ি পারো চলে এসো।
রিসিভার নামিয়ে রেখে বিল চুকিয়ে দিয়ে রওনা হয়ে গেল রানা। মনের ভেতর কেমন যেন ফুর্তি বোধ করছে ও। বেচে থাকার আনন্দ। জীবনে আবার ভোর দেখতে পাবে কল্পনাও করা যায়নি গতরাতে, অথচ ভোর হলো, বেঁচে আছে সে এখনও। নিছক বেঁচে থাকবার আনন্দে এতটা উদ্বেলিত হয়নি। রানা আর কোনদিন। নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে বেরিয়ে এসে এত আনন্দ হয়নি ওর আর কখনও।
সদ্য কেনা প্যাকেট থেকে বের করল সে দিনের প্রথম সিগারেট।
.
০৬.
শহরতলির কাছাকাছি পৌঁছে একটা হলুদ ট্যাক্সির জানালা দিয়ে ড্রাইভারকে হাত নাড়তে দেখে থেমে দাঁড়াল রানা। গাড়ি থেকে নেমে সোজা হয়ে দাঁড়াবার আগেই প্রায় উড়ে এসে হাজির হলো মারিয়া। নেভি র স্কাট আর জ্যাকেট পরেছে মারিয়া, সাদা রাউজ। সারারাত জেগে থাকার কোন চিহ্ন। নেই চোখে-মুখে। সদ্য ফোঁটা ফুলের মত লাগছে ওকে।
অপূর্ব! বলল মারিয়া রানার মুখের দিকে চেয়েই। চেহারার যা ছিরি। হয়েছে না! আস্ত একটা মামদো ভূত। একটা চুমো খেতে পারি?
না। আত্মসম্মান বজায় রাখবার চেষ্টা করল রানা। বসের সাথে তার অধীনস্থ কর্মচারী
হয়েছে, হয়েছে। চুপ করো। বিনা অনুমতিতেই টুক করে একটা চুমো খেলো মারিয়া রানার গালে। এবার শোনা যাক, কী করতে হবে আমাকে।
সোজা চলে যাও হাইলারে। বন্দরের কাছাকাছি অনেক রেস্তোরাঁ পাবে, যে কোন একটায় ঢুকে সেরে নাও ব্রেকফাস্ট। তারপর একটা বাড়ির
ওপর নজর রাখতে হবে তোমার। যতটা সম্ভব কাছে থেকে জাস্ট ওটার ওপর। চোখ রাখলেই চলবে। পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিল রানা ওকে বাডিটার। অবস্থান। বেশি কাছে যাবে না, আর সর্বক্ষণ তৎপরতারও দরকার নেই। শুধু খেয়াল রাখবে কি ধরনের লোক ওই বাড়িতে ঢুকছে বা বেরোচ্ছে। মনে রাখবে, তুমি একজন টুরিস্ট। লোকজনের মধ্যে, অথবা যতটা পারা যায়। লোকজনের কাছাকাছি থাকতে চেষ্টা করবে সবসময়। সোহানা কি ঘরেই?
হ্যাঁ। মুচকি হাসল মারিয়া। পাগলের মত ভালবাসে ও তোমাকে। ভাল কথা, একটা ফোন এসেছিল আমি যখন কাপড় ছাড়ছি সেই সময়। সোহানা ধরেছিল। ভাল খবর আছে।
এখানে সোহানা চেনে কাকে যে কেউ ফোন করে কোন সুখবর দেবে ওকে? একপর্দা চড়ে গেল রানার গলা নিজের অজান্তেই। কে ফোন করেছিল?
বিট্রিক্স শেরম্যান।
বিট্রিক্স শেরম্যান! কী যা-তা বলছ! এথেন্সে চলে গেছে ও কাল সকালে। ও আসবে কোত্থেকে?
ফিরে এসেছে আবার, পরম সহিষ্ণু ভঙ্গিতে বলল মারিয়া। ও পালিয়েছিল, তার কারণ তুমি যে দায়িত্ব দিয়েছিলে ওর ওপর সেটা এখানে। থেকে পালন করতে পারছিল না ও। সবসময় নাকি লোক লেগে ছিল ওর পেছনে। কাজেই এথেন্স চলে যাওয়ার ভান করে প্যারিস থেকে ফিরে এসেছে। আবার। হেনরীকে নিয়ে শহরের বাইরে এক বন্ধুর বাড়িতে আছে। বিট্রিক্সের এই কৌশলে যে ওঁর উপর খুবই খুশি হয়েছে মারিয়া, বোঝা গেল ওর সন্তুষ্ট হাসি দেখে। তোমার জন্যে সুখবর বিট্রিক্স জানিয়েছে, ক্যাসটিল লিন্ডেন সম্পর্কে তোমার সন্দেহ অমূলক নয়। তোমার নির্দেশমত ভলেনহোভেন। কোম্পানীতেও গিয়েছিল ও। সেখানে যদি যাও আশ্চর্য জিনিস আবিষ্কার… রানার মুখের দিকে চেয়ে ভয় পেল মারিয়া। কি হলো!
হায় আল্লা! দেখতে দেখতে বিকৃত হয়ে গেল রানার চেহারা। কি করলাম! কি করলাম এটা!
গাড়িতে উঠে পড়েছিল রানা, কোটের আস্তিন ধরে ফেলল মারিয়া। কি হয়েছে? কি করেছ!
এক্ষুণি যাওয়া দরকার আমার, মারিয়া। এক্ষুণি রওনা হতে হবে!
কিন্তু হঠাৎ কি হলো? কিছুই যে বুঝতে পারছি না আমি! আরও ভয় পেয়ে গেল মারিয়া।
মস্ত ভুল হয়ে গেছে, মারিয়া। সর্বনাশ যা হওয়ার হয়তো হয়ে গেছে। এতক্ষণে। বুঝতে পারছ না–বিট্রিক্স শেরম্যান কি করে জানল তোমাদের হোটেলের নাম্বার?
তাই তো! ভয়ানকভাবে চমকে উঠল মারিয়া এবার। হায় খোদা, সত্যিই তো! ও কি করে জানবে কোন হোটেলে উঠেছি আমরা?
একলাফে গাড়িতে উঠে দড়াম করে দরজা লাগাল রানা। পরমুহূর্তে, বাঘের মত লাফ দিল গাড়িটা সামনের দিকে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই রিয়ার ভিউ মিররে বিন্দুতে পরিণত হলো মারিয়া ডুক্লজ, তারপর নাই হয়ে গেল। তুমুল বেগে ছুটে চলেছে বিশেষ এঞ্জিন ফিট করা ওপেল। শহরের যত কাছে আসছে ততই রাস্তায় গাড়ির ভিড় বাড়ছে দেখে একটা বোতাম টিপে, দিল রানা। নীল ফ্ল্যাশিং লাইট চালু হয়ে গেল গাড়ির মাথায়। আরেকটা বোতাম টিপতেই শুরু হয়ে গেল সাইরেন। এবার এয়ারফোন জোড়া, দুইকানে পরে নিয়ে ঘাটাঘাটি শুরু করল ও রেডিও কন্ট্রোল, নব। খটর-মটর। আওয়াজ হচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই লাইন পাচ্ছে না রানা। এযন্ত্র কিভাবে অপারেট করতে হয় দেখে নেয়নি সে কারও কাছে, এখন দরকারের সময় এটাকে ব্যবহার করতে পারছে না দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল ওর নিজের। উপরই। একে তুমুল গতিবেগ-নজর রাখতে হচ্ছে রাস্তার উপর, একটু এদিক ওদিক হলেই যা তা কাণ্ড ঘটে যাবে, তার উপর এঞ্জিনের বিকট গর্জন, সেইসাথে সাইরেনের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ; এই সময় কানে যদি স্ট্যাটিকের খটর মটর কা আওয়াজ আসে, মেজাজ ঠিক রাখা কারও পক্ষেই বোধহয় সম্ভব না। হঠাৎ বাজে শব্দ থেমে গিয়ে শান্ত, দৃঢ় এক কণ্ঠস্বর ভেসে এল রানার কানে।