আসুন, আসুন। বসুন।
চেয়ারের দিকে এগোতে এগোতে হঠাৎ থমকে দাঁড়াল রানা। ফিরল কর্নেল ডি গোন্ডের দিকে।
অল্প কিছুক্ষণের জন্যে ক্ষমা করতে হবে আমাকে, কর্নেল, বলল সে। এক্ষুণি একজনের সাথে দেখা করতে হবে আমার। অত্যন্ত জরুরী। একেবারে ভুলে গিয়েছিলাম।
অবাক চোখে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল কর্নেল রানার মুখের দিকে। তারপর বলল, এতই জরুরী, এতই গুরুত্বপূর্ণ যে ভুলেই গিয়েছিলেন একেবারে?
টিটকারিটা গায়ে মাখল না রানা। এইভাবে ডেকে এনে হঠাৎ জরুরী কাজ পড়ে গেছে বললে কর্নেলের পক্ষে রেগে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। তেমনি। স্বাভাবিক ওর এই হঠাৎ ভয় পাওয়া। এক মুহূর্ত বিলম্ব সহ্য হচ্ছে না ওর যে, ভুল করে ফেলেছে, সেটা এক্ষুণি শুধরে নেয়ার চেষ্টা করতে হবে, নইলে পরে হয়তো আর সুযোগই পাওয়া যাবে না কোনদিন। লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, মানুষ মাত্রেরই ভুল হয়। নানান ঝামেলায় ভুলে গিয়েছিলাম। বেশি সময় লাগবে না আমার…
একটা ফোন করলে হয় না? এখান থেকে না হয়… টেবিলের উপর রাখা একটা টেলিফোন সেটের দিকে চোখের ইঙ্গিত করল কর্নেল।
নিশ্চয়, নিশ্চয়, বলে উঠল মোটা লোকটা। ইচ্ছে করলে আপনি এখান থেকেই…
সেটা সম্ভব নয়। আমার নিজের যেতে হবে।
কী এমন জরুরী, গোপনীয় ব্যাপার যেটা… রানার মুখের দিকে চেয়ে থেমে গেল কর্নেল।
আপনার গাড়ি এবং শোফার ধার নিতে পারি কয়েক মিনিটের জন্যে?
পারেন। নিরুদ্যম কণ্ঠে বলল কর্নেল। রানার খ্যাপামি দেখে মনে মনে বিরক্ত হয়েছে, বোঝা গেল।
আর..আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত যদি অপেক্ষা করতে পারেন…
কতক্ষণ? কতক্ষণ বসে থাকতে হবে আমাদের আপনার জন্যে?
কয়েক মিনিট। বেশি না।
মিনিট দুয়েক চলবার পর একটা কাফের সামনে থামতে বলল রানা মার্সিডিজের ড্রাইভারকে। গাড়ি ঘোরাতে বলে প্রায় দৌড়ে ঢুকে গেল। ভেতরে। ওদের টেলিফোন ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে দ্রুতহাতে ডায়াল করল সোহানাদের হোটেলের নাম্বারে। হোটেল ডেস্কের বুড়িকে ডিঙিয়ে ওদের ঘরে পৌঁছুতে আজ দশ সেকেন্ডের বেশি লাগল না।
সোহানা?
হ্যাঁ। কি খবর, রানা?
মারিয়া বেরিয়ে গেছে?
এই তো, ঘণ্টাখানেক হলো। আমিও বেরোচ্ছি…
শোনো। যে কাজ দিয়েছিলাম, তার চেয়েও জরুরী একটা কাজ পড়ে গেছে। এক্ষুণিআই রিপিট, এক্ষুণি এই হোটেল ছেড়ে দাও। এক্ষুণি বলতে আমি বোঝাচ্ছি বড়জোর দশ মিনিট। সম্ভব হলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে তোমাকে।
বেরিয়ে পড়তে হবে মানে
মানে জিনিসপত্র পাক করে বিল চুকিয়ে দিয়ে কেটে পড়তে হবে ওখান থেকে। অন্য কোন হোটেলে গিয়ে উঠবে। যে কোন হোটেল না, না, গভ, কার্লটনে না। তোমাদের যোগ্য যে-কোন হোটেলে। কেউ যেন অনুসরণ করতে না পারে সেজন্যে ট্যাক্সি যতগুলো খুশি ব্যবহার করতে পারো। হোটেলের টেলিফোন নাম্বারটা কর্নেল ডি গোল্ডের অফিসে ফোন করে জানাবে। উল্টে নেবে নাম্বারটা।
উল্টে নেব! সোহানার কণ্ঠস্বরে বিস্ময়। পুলিসকেও তুমি…।
কাউকেই বিশ্বাস করি না। আমরা এখানে কাজ করতে এসেছি, সোহানা, বিশ্বাস করতে নয়।
আর মারিয়া?
আগে হোটেল বদলাও। তারপর যেমনভাবে পারো এই হোটেলে উঠতে বাধা দাও মারিয়াকে। পার্কে না গিয়ে চেষ্টা করবে পথেই ওকে আটকাতে। মারিয়াকে ধরে নিয়ে চলে যাবে দুজন বিট্রিক্স শেরম্যানের আস্তানায়। এখন বাসাতেই পাবে আশা করি, বাসায় না পেলে খোঁজ করবে। ব্যালিনোভায়। ওকে বলবে, ওর ভালর জন্যেই ওর এখন তোমাদের সাথে নতুন হোটেলে থাকা দরকার। যতক্ষণ না ওর বাইরে বেরোনো আমি নিরাপদ মনে করছি ততক্ষণ ওর থাকতে হবে তোমাদের সাথে।
আর ওর ভাই…
ওর ভাই থাকুক যেখানে আছে সেখানেই। আপাতত ওর কোন বিপদ। দেখতে পাচ্ছি না। বিপদ এখন তোমাদের তিনজনের মাথার ওপর। যদি তোমাদের সাথে যেতে ও রাজি না হয়, ওকে বলবে হেনরীর ব্যাপারে পুলিসে। ফোন করবে তাহলে তুমি
পুলিসে ফোন করব!
দরকার হবে না, পুলিসের নাম শুনলেই সুড়সুড় করে তোমাদের পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করবে মেয়েটা।
কিন্তু অন্যায় হয়ে যাচ্ছে না? মানে, পুলিসের ভয় দেখিয়ে একটা মেয়েকে…
তর্ক কোরো না, সোহানা। যা হুকুম করছি, পালন করো। বলেই নামিয়ে রাখল রানা রিসিভার।
ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফিরে এল সে ওয়েরহাউজের অফিসরুমে। ইতিমধ্যেই এখানে আসবার কারণ জানানো হয়েছে ভলেনহোভেনকে। রানা ঢুকে দেখল অমায়িক, দয়ালু ভাবটা দূর হয়ে গেছে মোটা লোকটার মুখের চেহারা থেকে, সেই জায়গায় ফুটে উঠেছে অসন্তোষ বিক্ষোভ আর অবিশ্বাস। বুক পর্যন্ত ঝুলে পড়া থুতনি কাঁপছে আবেগে। একহাতে ধরা রয়েছে একটা কাগজ। খসে পড়ে গেল কাগজটা টেবিলের উপর।
সার্চ ওয়ারেন্ট! দুঃখে ফেটে যাচ্ছে ভলেনহোভেনের বুক। পাথরের মূর্তি পর্যন্ত কেঁদে বুক ভাসিয়ে দেবে ওর এক্সপ্রেশন দেখে। চেহারাটা অর্ধেক। হলে, বেশ মানিয়ে যেত হ্যামলেট হিসেবে। দেড়শো বছর ধরে বাপ দাদারও বাপের আমল থেকে ব্যবসা করছি আমরা ভলেনহোভেন ফ্যামিলি, সম্মানের সাথে, সতোর সাথে। আজ তার এই পরিণতি! ভলেনহোভেন কোম্পানীতে সার্চ ওয়ারেন্ট! হায়রে, এই ছিল কপালে! শুনলে এক্ষুণি হার্টফেল করবে আমার বুড়ো বাপ। নিজের কপালে দুটো চাপড় দিল। লোকটা। এইবার চুনকালি পড়ল গেল গুডউইল! সর্বনাশ! সার্চ ওয়ারেন্ট! নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করল সে কয়েক সেকেন্ড, তারপর চোখ বুজল, ঠিক আছে, সার্চ করুন। যেখানে খুশি, যা খুশি দেখুন সার্চ করে। আমার কোন আপত্তি নেই।