যেমন রেখে গিয়েছিল, ঠিক তেমনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে গাড়িটা গ্রামের পোস্ট অফিসের সামনে। সাইকেলটা দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে টেলিফোনের দিকে চাইল রানা একবার, তারপর হাতঘড়ির দিকে চেয়ে মত পরিবর্তন করে উঠে বসল পুলিস-কারে। এত ভোরে ওদের কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না।
বড় রাস্তা ধরে মাইলখানেক গিয়ে গাড়ি থামাল রানা, বুট থেকে কাপড়ের প্যাকেটটা বের করে পেছনের সীটে বসে ভেজা কাপড় ছেড়ে পরে নিল। শুকনো কাপড়, গাড়ির এঞ্জিন চালু রেখেই। হিটারটা চালু করে দিয়েছিল। গাড়িতে উঠেই, এতক্ষণে গরম বাতাস ঢুকতে শুরু করেছে নানান ফোকর। দিয়ে। আবার ছুটল রানা। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, গাড়ির ভেতরটা গরম হয়ে, ওঠায় আরাম পেয়ে ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে ওর শরীরটা, মনে হচ্ছে। গাড়ি চালাতে চালাতেই ঢলে পড়বে ঘুমে। চট করে হিটার অফ করে দিয়ে। গতিআর একটু বাড়িয়ে দিল সে। মাইলদুয়েক গিয়ে রাস্তার ধারে একটা ছোট্ট বাংলো পাওয়া গেল, একটা সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে মোটেল মোটেল হোক আর যাই হোক, খোলা দেখে ব্রেক চাপল রানা। ঢুকে পড়ল ভেতরে।
মোটেলের কর্ত্রী জিজ্ঞেস করল ব্রেকফাস্ট লাগবে কিনা। মাথা নেড়ে সায় দিয়ে জঞ্জ জেনেভারের বোতলের দিকে আঙুল তুলে দেখাল রানা। কথা বলবার সাহস হলো না ওর, পাছে গলা দিয়ে আওয়াজ না বেরোয়। এই ভোরে নাশতার আগেই বোতলের দিকে রানাকে ইঙ্গিত করতে দেখে অবাক। হয়ে গেল মোটা মহিলা, হয়তো বা ওর এলোমেলো ভেজা চুল দেখে ভয়ও পেল একটু, কিন্তু কিছু না বলে বোতলটা এগিয়ে দিল সে রানার দিকে, তার। পাশে ঠক করে নামিয়ে রাখল একটা গ্লাস। ইঙ্গিতে মহিলাকে বোতল থেকে তরল পদার্থ গ্লাসে ঢেলে দেয়ার অনুরোধ করে রানা শুধু বলল, প্লীজ! শব্দটা শোনাল পি-প্লীজের মত।
মদ ঢালা হতেই কাঁপাহাতে গ্লাসটা তুলে নিয়ে গলায় ঢালতে গিয়ে। অর্ধেকই পড়ে গেল রানার চিবুক বেয়ে। দ্বিতীয় গ্লাসের সিকি ভাগ পড়ল। তৃতীয় গ্লাসের থেকে এক ফোঁটাও পড়ল না বাইরে। চতুর্থ গ্লাসটা রানা যখন হাতে তুলে নিল, তখন বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে মহিলা রানার হাতের দিকে–একবিন্দু কাঁপছে না হাতটা এখন, মনে হচ্ছে পাথর দিয়ে তৈরি।
মাই গড! মহিলার কণ্ঠস্বরে শুধু বিস্ময় নয়, মমতারও আভাস পাওয়া। গেল। তুমি তো দেখছি, বাছা, ভয়ানক কাহিল অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিলে! ভাগ্যিস এই পর্যন্ত এসে পৌঁছুতে পেরেছিলে, আগেই মূৰ্ছা যাওনি! ব্যস্ত হয়ে। পড়ল মহিলা মোটা শরীর নিয়ে। বসে পড়ো, বসে পড়ো। তোমার জন্যে। ব্রেকফাস্ট তৈরি করে ফেলছি আমি তিন মিনিটে।
অপেক্ষাকৃত ধীরে চতুর্থ গ্লাস শেষ করে শরীরে অনেকখানি বল ফিরে পেল রানা। শরীরের ভেতর প্রবলবেগে ছোটাছুটি শুরু করেছে এখন লোহিত কণিকাগুলো। একটু সুস্থির হয়ে বাথরূম সেরে এল সে তিনমিনিটে, মোটেলের বাথরূমে একটা ইলেকট্রিক রেজর পেয়ে দাড়িগুলোও কামিয়ে নিয়েছে। ঝটপট। তারপর তৃপ্তির সাথে ডিম, মাংস, পনির, চার পদের রুটি, আর গ্যালনখানেক কফি খেয়ে একটা টেলিফোন করবার অনুমতি চাইল।
ডায়াল করবার সাথে সাথেই শোনা গেল নরম পুরুষকণ্ঠ হোটেল প্লাযা।
আমি মাসুদ রানা। সোহানা চৌধুরীকে চাই, ওদের কামরায় কানেকশন দিন।
প্রায় এক মিনিট পর মারিয়ার ঘুমঘুম কণ্ঠস্বর ভেসে এল হ্যালো? কে বলছেন?
মানসচক্ষে পরিষ্কার দেখতে পেল রানা মারিয়াকে, আড়মোড়া ভাঙছে রিসিভার কানে ধরে, হাই তুলছে।
বেলা দুপুর পর্যন্ত ঘুমোবার পারমিশন কে দিয়েছে তোমাদের? কর্কশ। কণ্ঠে বলল রানা।
কে? কি বলছেন? রানার গলা চিনতে পারেনি মারিয়া।
গতকাল বাকি দিনটা ছুটি দেয়া হয়েছিল, তাই বলে আজকেও বেলা দুপুর পর্যন্ত কে ঘুমোতে বলেছে তোমাদের? রিস্টওয়াচের দিকে চাইল রানা। সকাল পৌনে আটটা। কয়টা বাজে সে খেয়াল আছে?
কে..তুমি? তুমি বলছ, রানা?
তাছাড়া আবার কে? মাসুদ রানা দি গ্রেট। তোমাদের প্রিয়তম প্রভু। জঞ্জ জেনেভারের ঠেলায় তুঙ্গে উঠে আছে রানার মৃড়।
সোহানা! চেঁচিয়ে উঠল মারিয়া। ফিরে এসেছে। আমাদের প্রিয়তম প্রভু বলছে নিজেকে। মারিয়ার কণ্ঠে স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের আভাস পেল রানা।
শোকর আলহামদুলিল্লাহ! দূর থেকে সোহানার গলাও শুনতে পেল রানা। আমাদের দোয়া কাজে লেগেছে, মারিয়া!
ওদের দুজনকে এত খুশি হয়ে উঠতে দেখে আশ্চর্য একটা কৃতজ্ঞতাবোধ স্পর্শ করল রানার অন্তর। গতরাতে মারা যাচ্ছিল সে আর একটু হলে, কঠোর সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়েছে ওর–এই সংগ্রাম যে কেবল নিজের জন্যে নয়, আরও মানুষ খুশি হয় ও বেঁচে থাকলে, সেটা বুঝতে পেরে হঠাৎ ভিজে এল ওর চোখের পাতা। সামলে নিয়ে বলল, যথেষ্ট হয়েছে। এত বেলা পর্যন্ত পড়ে পড়ে ঘুমোতে হবে না। এবার কাপড় পরে তৈরি হয়ে নাও। কাজ আছে।
ঘুমোলাম কোথায়! সারারাতই তো জেগে আছি। আমাদের ক্রাইস্ট আর তোমাদের মুহামেড-দুই প্রফেটকে অস্থির করে রেখেছি দুজন মিলে। সারারাত। এই তত আধঘন্টাও হয়নি বিছানায়
ভুলে যাও। সোহানা ঘরে থাকুক, তুমি ঝটপট কাপড় পরে বেরিয়ে পড়ো এক্ষুণি। নো ফোমবাথ, নো ব্রেকফাস্ট। একটা ট্যাক্সি নিয়ে…