জেটির দিকে চেয়ে দেখল রানামাল খালাস শুরু হয়ে গেছে বাজ থেকে। একটা ক্রেন আংটায় বাধিয়ে নানান আকৃতির কাঠের বাক্স, বস্তা তুলে আনছে। বার্জের হোল্ড থেকে। কি মাল খালাস হচ্ছে সে নিয়ে এক সেকেন্ড সময়ও নষ্ট করল না রানা। ওসবের মধ্যে যে বেআইনী কিছু নেই সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত। আসলে নজর রাখতে হবে ওর কেবিনের উপর। বিশেষ একটা বাক্স কোথায় যায় দেখতে হবে।
আধঘণ্টা চুপচাপ শুয়ে থাকার পর দেখা গেল দুজন লোক বেরিয়ে এল বার্জের কেবিন থেকে। একজনের মাথায় মস্ত এক বস্তা। মুচকি হাসল রানা ঠোঁট বাকা করে। যদিও প্রচুর খড়কুটো ভরে গোল করা হয়েছে বস্তাটাকে, দুটো দিকে পরিষ্কার চৌকোণ বাক্সের আভাস দেখতে পাচ্ছে সে। গ্যাঙওয়ে। বেয়ে নেমে এল ওরা বার্জ থেকে, জেটি পেরিয়ে রাস্তায় পড়ল। মোটামুটি কোনদিকে যাচ্ছে ওরা বুঝে নিয়ে সড়সড় করে নেমে এল রানা ডাইক থেকে, বেশ কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে চলল ওদের পিছুপিছু।
ওদের অনুসরণ করায় কোন মুশকিল দেখা দিল না। ওদের চলার ভঙ্গিতে, পরিষ্কার বোঝা গেল, ওদেরকে যে কেউ কখনও অনুসরণ করতে পারে সেই সন্দেহই জাগেনি ওদের মনে কোনদিন। আঁকাবাকা রাস্তায় নিশ্চিন্ত মনে হেঁটে চলল রানা ওদের পেছনে, একবার ঘাড় ফিরিয়ে চাইলও না কেউ। আসলে এই কাজটা এতবার নির্বিবাদে সেরেছে যে সাবধানতার ধারটা নষ্ট হয়ে গেছে ঘষায় ঘষায়, বেআইনী কিছু করছে সে কথাই হয়তো ভুলে গেছে, এমনই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এ-রাস্তা ও-রাস্তা বেয়ে ছোট্ট শহরের উত্তর প্রান্তে চলে। এল ওরা। বড়সড় একটি বাড়ির সামনে দাঁড়াল। চল্লিশ গজ দূর থেকে রানা। দেখল, এ বাড়িটাও অন্যগুলোর মত থামের উপর উঁচু করে তৈরি বটে, কিন্তু এর থামগুলো রিইনফোর্সড কংক্রিটের, নিচতলার দেয়ালগুলোও টিনের নয়, পাকা। একটা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল লোক দুজন। দোতলার বন্ধ জানালাগুলোর শিকগুলো এত ঘন এবং মোটা যে বড় সাইজে একটা ছুচোও ঢুকতে পারবে কিনা সন্দেহ। দরজায় তিনটে তালা–গুণ চিহ্নের মত করে লাগানো দুটো লোহার বারের দুমাথায় দুটো, দরজার ভার। কড়ায় লাগানো একটা। একজন পকেট থেকে চাবি বের করে একে একে খুলে ফেলল তিনটে তালা, ভিতরে গিয়ে ঢুকল দুজন, ঠিক এক মিনিটের মধ্যে বেরিয়ে এল দুজনই। বস্তাটা রেখে এসেছে ভেতরে। দরজায় তালা লাগিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে ফিরে চলল যে পথে এসেছিল সেই পথে।
স্কেলিটন চাবির গোছাটা সাথে করে না আনায় মুহূর্তের জন্যে। অনুশোচনার খোঁচা লাগল রানার বুকে। পরমুহূর্তে বুঝতে পারল ওটা সাথে না এনে ভালই করেছে সে। একে তো ওই ঘরের দিকে মুখ করে রাস্তার এপাশে দশ-পনেরোটা বাড়ির বিশ-তিরিশটা জানালা রয়েছে, তালা খোলার চেষ্টা করতে গেলে যেকোন লোকের চোখে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবং ওকে দেখে যেকোন হাইলারবাসী বলে দিতে পারবে ও বিদেশী; তার ওপর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, সময় আসেনি এখনও। এখন নাড়াচাড়া করলে ধরা। পড়বে চুনোপুটি। চুনোপুঁটির জন্যে বাংলাদেশ থেকে এতদূরে আসেনি। রানাও ধরতে এসেছে তিমি, মারতে এসেছে হাঙর। ওই বাক্সের মধ্যে টোপ রয়েছে হাঙরের। অধৈর্য হয়ে কিছু করে বসলে একেবারে পগার পার হয়ে যাবে হাঙর-কুমির-তিমি, সব।
বন্দরটা পশ্চিমে, কাজেই গাইডবুক বা ম্যাপ ছাড়াই বুঝে নিল রানা, অ্যামস্টার্ডাম ফেরার বাস টারমিনাল পাওয়া যাবে শহরের পূবদিকে। আঁকাবাকা রাস্তা ধরে পূর্ব দিকে রওয়ানা হয়ে গেল রানা। সরু একটা খালের। ওপর দিয়ে একটা পিঠ কুঁজো ব্রিজ পেরোতে গিয়ে প্রথম সাক্ষাৎ হলো ওর সভ্য মানুষের সাথে। তিনজন মাঝবয়সী মহিলা পড়ল সামনাসামনি, প্রত্যেকেই হাইলারের বিশেষ কস্টিউম পরা। তিনজনই সহজ ভঙ্গিতে চাইল রানার দিকে, তারপর চোখ ফিরিয়ে নিয়ে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল সামনে। যেন হাইলারের রাস্তায় সাতসকালে চুপচুপে ভেজা বিদেশী দেখে,দেখে চোখে ছানি পড়ে গেছে ওদের, কৌতূহলী হওয়ার কিছুই নেই।
মহিলা তিনজনকে নিরুৎসুক ভঙ্গিতে এগিয়ে যেতে দেখে ভেতর ভেতর। ভয়ানকভাবে চমকে উঠল রানা। ব্যাপারটা একটু গভীরভাবে তলিয়ে দেখতে। গিয়ে নিজের কাজের মধ্যে গোটাকয়েক মারাত্মক ত্রুটি টের পেল সে। কমপক্ষে তিনটে ভুল করেছে সে গতকাল।
কয়েকগজ এগিয়েই একটা বড়সড় কার-পার্ক দেখতে পেল রানা। দুটো গাড়ি আর গোটা ছয়েক বাইসাইকেল দেখতে পেল সে পার্কে। গাড়িগুলো লক করা, কিন্তু একটা সাইকেলেও তালা বা চেইন দেখতে পেল না সে। বোঝা গেল এখানকার লোক করলে বড় ধরনের কিছুই করে, ছ্যাচড়া চুরি চামারির মধ্যে নেই। আশপাশে জনপ্রাণীর চিহ্ন দেখতে পেল না রানা। গেটটা তালা মারা। তালা মেরে দিয়ে অ্যাটেনড্যান্ট নিশ্চয়ই নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছ ওপাশের ছোট্ট ঘরটায়। দেয়াল টপকে ভেতরে চলে এল রানা। এক সেকেন্ডের জন্যে অপরাধবোধ দ্বিধান্বিত করল ওকে, তারপর সবচেয়ে ভাল সাইকেলটা বেছে নিয়ে ওটাকে শূন্যে তুলে পার করল গেটের ওপাশে, গেটের গায়ে হেলান দিয়ে রেখে বেরিয়ে এল দেয়াল টপকে। চোর, চোর বলে চিৎকার করল না কেউ। উঠে পড়ল রানা সাইকেলে।
অভ্যেস নেই অনেকদিন। প্রথম কিছুক্ষণ হাত কাপল, তারপর পঙ্খীরাজের মত ছুটল সে টারম্যাকের হাইওয়ে ধরে মূলভূমির দিকে। মনে মনে খুশি হয়ে উঠল সে–এটা হাঁটার চেয়ে অনেকগুণে ভাল হলো। এই চেহারা নিয়ে বাসে ওঠা ঠিক হত না কিছুতেই। বাতাস কেটে এগোলোর ফলে শীত করছে খুবই, বিশেষ করে শরীরের উপরের অংশটা আবার বরফ হয়ে যাবার উপক্রম করছে, তবু এ কষ্ট রাতের তুলনায় কিছুই না, মনে মনে। নিজেকে এই সান্তনা দিয়ে দাতে দাঁত চেপে প্যাডেল করে চলল রানা দ্রুতবেগে।