সময় বয়ে চলল। ঘটনাবিহীন। ঠকঠক করে কাঁপছে রানার সর্বশরীর, মাঝে মাঝে কুকুরের গা ঝাড়া দেয়ার মত করে শিউরে শিউরে উঠছে। এত কষ্ট জীবনে পায়নি সে কোনদিন.। মনে মনে স্থির করল, যদি প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরতে পারে, তাহলে অন্তত দুমাসের বেতন এক সাথে করে পুরানো গরম। কাপড় কিনবে সে সদরঘাটের পাইকারদের কাছ থেকে–দান করবে। স্টেডিয়ামের অর্ধ উলঙ্গ লোকগুলোকে। কথাটা মাথায় আসতেই আরও কিছু সংশ্লিষ্ট চিন্তা এসে ভিড় করতে চাইল ওর মনের মধ্যে। একজন মাসুদ রানা তার দুমাসের কেন, সারা বছরের বেতন দিয়ে গরম জামা কিনে বিলিয়েও প্রয়োজন মেটাতে পারবে না স্টেডিয়ামবাসীদের। কয়জনকে দেবে সে? যারা, পেল, তাদের শীতটা না হয় কিছুটা প্রশমিত হলো–খিদেটা? গরম পেলেই কি, খিদেটা মিটবে? কয়জনকে খাওয়াতে পারবে সে? কতদিন? খাওয়ার পর চাই শিক্ষা, তারপর চাই কাজের সুযোগ। ধুত্তোর বলে ক্ষ্যান্ত দিল রানা। ঠিক করল কাউকে কিছু দেবে না। এটা রাষ্ট্রীয় সমস্যা-রাজনৈতিক সমাধান বের। করতে হবে এর। সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। যাদের উপর। নেতৃত্বের ভার রয়েছে তারা করুক একটা কিছু, বের করুক সমাধান। এই নিদারুণ দারিদ্রের পীড়ন থেকে ওরা যদি দেশবাসীকে মুক্তি দিতে না পারে গদি আঁকড়ে ধরে রাখতে পারবে না কেউ, নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবার। জন্যেই ওদের উচিত মানুষের মঙ্গলচিন্তায় মন দেয়া, একটা কিছু পথ বের করে সেই পথে নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যাওয়া। তা তারা করবেও। বাধ্য হবে করতে। আজ না হোক, কাল।
এই পর্যন্ত এসে আবার হোঁচট খেলো রানা। সত্যিই কি তাই? তাহলে দিনের পর দিন এক পা দুই পা নয়, দশ পা বিশ পা করে পিছিয়ে যাচ্ছে কেন দেশটা? নিজেকে রাজনীতির বাইরে ভাবলেই কি ওর দায়িত্ব শেষ? ওর নিজের করবার কিছুই নেই?
আপাতত শীতে ঠকঠক করে কাঁপা ছাড়া আর কি করবার আছে বুঝতে পারল না রানা। ভেবেছিল, এই কষ্টের বাড়া আর কোন কষ্ট হতেই পারে না, কিন্তু ভোর চারটের দিকে ভুল ভাঙল ওর। ঠিকই বলেছিল মারিয়া আজ রাতে লাক ফেভার করবে না ওকে। বরফকে হার মানায় এমনি বৃষ্টি নামল। মুষলধারে। শরীরের তাপে ভেজা গেঞ্জি যাও বা একটু শুকিয়ে এসেছিল, ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল আবার। শুধু ঠাণ্ডা নয়, একেকটা ফোঁটা তীরের মত এসে বিধছে চোখে মুখে। দশমিনিট ভেজার পর হঠাৎ ভয় পেয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে। বসল রানা। অবশ হয়ে যাচ্ছে ওর সারা শরীর। গায়ের চামড়ায় চিমটি কেটে দেখল-মনে হলো চামড়ার গ্লাভসের উপর চিমটি কাটছে। আর কিছুক্ষণ এই ভাবে থাকলে নড়াচড়ার শক্তি সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলবে সে।
এদিকে ভোরের আভাস দেখা যাচ্ছে পুব আকাশে। আর বেশিক্ষণ হুইলহাউজের ছাদের উপর থাকাও নিরাপদ নয়। হাইলার দ্বীপের কেউ না কেউ নিশ্চয়ই এই বার্জের অপেক্ষায় আছে, নিশ্চয়ই আর খানিকটা আলো হলেই খুজবে এটাকে বিনকিউলার চোখে দিয়ে। হুইলহাউজের উপর একজন। লোককে শুয়ে থাকতে দেখলে অত্যন্ত সন্দিগ্ধ হয়ে উঠবে তার মন।
বুকে হেঁটে লোহার মইয়ের কাছে চলে এল রানা। চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিয়ে সন্তর্পণে নেমে এল নিচে। কেবিনের ভেতর লেপের নিচে আরামে ঘুমিয়ে থাকা লোকগুলোর কথা ভেবে তীব্র ঈর্ষা বোধ করল নিজের ভেতর। দ্রুতপায়ে চলে এল সে বার্জের গায়ে বাধা টায়ারের কাছে। নেমে পড়ল। পানিতে। পানিতে নেমেই নিজেকে যা-তা ভাষায় গাল দিল রানা এতক্ষণ খামোকা কষ্ট করার জন্যে। চমৎকার গরম পানি। গরম মানে, আসলে ঠাণ্ডা, কিন্তু বৃষ্টির পানির তুলনায় রানার মনে হলো সাগরের পানি তো না, যেন। চায়ের কাপে নেমেছে সে।
হাইলার দ্বীপের উত্তর তীর দেখা গেল। আবছাভাবে। বাজঁটা দক্ষিণ পশ্চিম দিয়ে ঘুরে গিয়ে পৌঁছুবে সেই ছোট বন্দরে। এত ধীরে চলেছে যে রানার মনে হলো দুপুর হয়ে যাবে এটার বন্দরে গিয়ে ভিড়তে। তীরের দিকে। চাইলে মনে হচ্ছে, থেমে রয়েছে এক জায়গায়। বেলা উঠে গেলে যে ওর পক্ষে আত্মগোপন করে থাকা খুবই অসুবিধেজনক হয়ে পড়বে সেদিকে লক্ষ নেই কারও।
সূর্য উঠল ভোর পাঁচটার দিকে। কিন্তু মিনিট দশেক পরেই আবার ওটাকে মেঘের নিচে ঢাকা পড়তে দেখে হাঁপ ছেড়ে বাচল রানা। মেঘেরই জয়। হলো। আরও চেপে, আরও বড় বড় ফোঁটায় চারদিক আধার করে যেন। সারাদিনের প্রোগ্রাম নিয়ে নামল আবার বৃষ্টি। টায়ার আঁকড়ে ধরে দাতে দাঁত চেপে ঝুলে রইল সে গলা পর্যন্ত পানিতে ডুবে।
ছয়টার দিকে নেভিগেশন মার্ক দেখতে পেল রানা। ঘুরতে শুরু করেছে বাৰ্জটা ওই দিকে। এসে গেছে বন্দর। হাতটা ছেড়ে বার্জের পেটে জোড়া পায়ের একটা লাথি মেরে দূরে সরে গেল রানা। দুপাশে ঢেউ তুলে চলে গেল। বার্জ সামনের দিকে, তারপর বাঁক ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
ঠাণ্ডায় প্রায় অসাড় হয়ে গেছে রানার হাত-পা। মিনিট পাঁচেক সাঁতার কাটবার পর একটু একটু করে সাড়া ফিরে এল ওগুলোতে। নেভিগেশন মার্ক ডাইনে রেখে বন্দরের কাছাকাছি তীরে উঠে পড়ল সে। ঠিক এমনি সময়ে থেমে গেল বৃষ্টি। বুকে হেঁটে উঠে পড়ল সে ডাইকের উপর। এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে বন্দরের দুটো জেটি। শহরেরও অনেকখানি দেখতে পেল, রানা। বেশির ভাগ বাড়িই সবুজ আর সাদা দিয়ে পেইন্ট করা। প্রত্যেকটা বাড়িই তৈরি করা হয়েছে মোটা থামের উপর। সামুদ্রিক বন্যার ভয়ে। বাড়িতে উঠতে হলে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। তবে নিচটা একেবারে বেকার যেতে দেয়নি হাইলারবাসীরা, ঘিরে নিয়ে বাথরূম, কিচেন আর স্টোর করেছে। শহরের একটা রাস্তা (খুব সম্ভব এটাই অ্যামস্টার্ডাম যাওয়ার রাস্তা) ছাড়া বাকি সবগুলোই অজগর সাপের মত আঁকাবাঁকা।