কিছুদূর পিছিয়েই রানাকে ঠেলে নিয়ে বাম দিকে সরতে শুরু করল বাজটা। সোজা হয়ে নিয়েই রওনা হয়ে যাবে সামনের দিকে। ক্ষোভে দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করল রানার। পাগলের মত দুহাত বাড়িয়ে খুঁজছে সে। অন্তত ধরে ঝুলে থাকবার মত কিছু একটা। কিছুই বাধছে না হাতে। হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে হঠাৎ একটা টায়ারের সাথে ধাক্কা খেলো রানা। ট্রাকের টায়ার। বার্জ ভিড়বার সময় বোটের গায়ে যেন চোট না। লাগে সেজন্যে বাধা রয়েছে পেটের কাছে। মুহূর্তে রানার হতাশা রূপান্তরিত হলো স্বস্তির হাসিতে। সামনের দিকে চলতে শুরু করল বাজ। টায়ারের গায়ে পা বাধিয়ে উঁচু হয়ে ধরে ফেলল রানা বার্জের একটা ক্যাপস্টান, সাবধানে মাথা তুলে চাইল চারপাশে।
হুইলহাউজের জানালা দিয়ে মাথা বের করে নেভি-ক্যাপ পরা একজন লোক কি যেন নির্দেশ দিচ্ছে একজন নাবিককে। লোকটা চলে গেল সামনের দিকে। উঠে পড়ল রানা উপরে। নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে গেল হুইলহাউজের দিকে। হুইলহাউজের সাথেই লাগানো ত্রুদের কেবিন। লোহার মই বেয়ে কেবিনের ছাতে উঠে পড়ল রানা, তারপর অতি সন্তর্পণে বুকে হেঁটে চলে এল। হুইলহাউজের মাথায়। নেভিগেশন লাইট জ্বলে উঠল হুইলহাউজের ছাতের। দুইধারে। কিন্তু তাতে বিচলিত হলো না রানা। ওই আলো দুটো জ্বলে ওঠায় ও যেখানে শুয়ে আছে সে জায়গাটা আরও অন্ধকার দেখাচ্ছে।
আরও কিছুটা গম্ভীর হলো এঞ্জিনের শব্দ। ভোলা সমুদ্রের দিকে এগোচ্ছে এখন বার্জটা।
পিস্তলটা বের করে তৃতীয় ম্যাগাজিন পুরল রানা। মাথার পাশে ওটা রেখে শুয়ে পড়ল চিৎ হয়ে। স্মৃতি রোমন্থনে মন দেয়ার চেষ্টা করল সে ভাঙা। চাঁদের দিকে চেয়ে। আসলে সময় কাটাতে চায়। কিন্তু কিসের কি! খোলা সমুদ্রে পড়তেই প্রচণ্ড শীতের ঠেলায় উড়ে গেল সব স্মৃতি। নিদারুণ কঠোর। বাস্তব ছাড়া আর কিছুই ছাপ ফেলতে পারছে না ওর বর্তমান চেতনায়। অতীত-ভবিষ্যৎ সব এখন ওর কাছে অর্থহীন।
.
০৫.
শীত কাকে বলে টের পেল রানা আজ হাড়ে হাড়ে।
আজ রাতে সমুদ্র যাত্রায় যাবে সেটা জানা ছিল ওর, কিন্তু যাত্রার শুরুতেই যে এইভাবে ভিজতে হবে কল্পনাও করতে পারেনি। ওর মনে হলো। শীতে জমেই মারা যাবে সে আজ রাত ফুরোবার আগে। যাইডার যীর। নিশিরাতের হাওয়া আগাগোড়া লেপমুড়ি দেয়া লাশেরও সারা শরীরে কাপন তুলে দিতে পারেনা রয়েছে ভেজা কাপড়ে। হিমশীতল বাতাসে খানিক, বাদেই মনে হলো জমাট বরফে পরিণত হয়েছে ওর শরীরটা। শুধু বরফ নয়, কম্পমান বরফ। প্রাণপণ শক্তিতে দাতে দাঁত চেপে না রাখলে এতক্ষণে ওর। চারপাশে জমায়েত হয়ে যেত বার্জের সব লোক খটাখট ক্ল্যাপারের শব্দে।
অ্যামস্টার্ডামের বাতিগুলো নিষ্প্রভ হতে হতে শেষ পর্যন্ত মিলিয়ে গেল। বহুদূরে। রানা লক্ষ করল, বেলজিয়ান কোস্টার মেরিনোর মতই এই বাজটাও একেবারে বয়াগুলোর গা ঘেষে এগোচ্ছে। দুটো বয়ার গা ঘেষে পার হয়ে তৃতীয় একটার দিকে প্রায় সোজাসুজি রওনা হলো বাটা। মনে হচ্ছে সোজা গিয়ে চারশো গজ দূরের ভাসমান বয়ার সাথে ধাক্কা খাবে।
হঠাৎ এঞ্জিনের শব্দ কমে গেল। মাথাটা সামান্য উঁচু করে চারপাশে চাইল রানা। দুজন লোক কেবিন থেকে বেরিয়ে এল ডেকের উপর। চট করে। মাথা নিচু করে হুইলহাউজের ছাতের সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করল রানা। কিন্তু এদিকে এল না লোক দুজন। দ্রুতপায়ে চলে গেল ওরা সামনের গলুইয়ের দিকে। কি করছে দেখবার জন্যে কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে মাথাটা, উঁচু করল রানা পাশ ফিরে।
একজন লোকের হাতে ছয়ফুট লম্বা একটা লোহার ডাণ্ডা দেখতে পেল রানা, দুমাথায় রশি বাধা। গলুইয়ের কাছে গিয়ে দুজন ধরল রডের দুপাশের রশি, দুজনেই একটু একটু করে ছেড়ে পানির লেভেল পর্যন্ত নামাল রডটাকে, তারপর হুইলহাউজের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল আদেশের অপেক্ষায়। চোখ তুলে বয়াটার দিকে চাইল রানা, বিশগজ আছে আর। বাজটাকে এমনভাবে চালানো হচ্ছে যে ঠিক বয়াটার পাঁচফুট দুর দিয়ে চলে যাবে। গতি অনেক কমে গেছে। হুইলহাউজ থেকে তীক্ষ্ণ কণ্ঠের আদেশ শুনতে পেল রানা। সাথে সাথেই রশি ছাড়তে শুরু করল লোক দুজন। সড়সড় করে চলে যাচ্ছে রশি ওদের হাতের মুঠোর মধ্যে দিয়ে। একজন গুনছে এক, দুই, তিন করে। রানা। বুঝল, দুটো রশিতেই সমান দূরে দূরে একটা করে গিঠ দেয়া আছে। গোণা হচ্ছে এই জন্যে যে দুইজনকেই সমান ঢিল দিতে হবে রশিতে, আগে পরে। হলে চলবে না–সমান্তরাল রাখতে হবে লোহার রডটা।
বাৰ্জটা ঠিক যখন বুয়ার পাশাপাশি এল, নিচু গলায় কি যেন বলে উঠল দুজনের মধ্যে একজন। সাথে সাথেই রশি ছাড়া বন্ধ করে ধীরে ধীরে টানতে শুরু করল ওরা কি উঠে আসবে মোটামুটি আন্দাজ করে নিয়েছে রানা, বুঝে গেছে কায়দাটা, কিন্তু তাই বলে চোখ ফেরাতে পারল না। গভীর। মনোযোগের সাথে লক্ষ করছে সে ওদের কার্যকলাপ।
প্রথমে পানির উপর ভেসে উঠল একটা, দুফুট লম্বা সিলিন্ডার আকৃতির। বয়া, তারপর উঠল বয়ার সাথে বাধা ছোট্ট একটা চার-আংটার নোঙর। এই নোঙরের সাথেই আটকে আছে লোহার রডটা। নোঙরের পর উঠে এল রশি। বাধা একটা বাক্স। দেখে মনে হচ্ছে টিনের তোরঙ্গ। তিনফুট লম্বা, দুইফুট চওড়া, দেড়ফুট উঁচু। বাক্সটা চট করে কাঁধে তুলে নিল একজন, প্রায় দৌড়ে চলে গেল কেবিনের ভেতর। দ্বিতীয়জন বয়া আর নোঙরটা নামিয়ে দিল আবার। পানিতে। সাথে সাথেই আবার বেড়ে গেল এঞ্জিনের গর্জন, পূর্ণবেগে ছুটছে। বার্জ যাইডার যী ধরে হাইলার দ্বীপের দিকে। পুরো ব্যাপারটা এতই দক্ষতার সাথে এতই নিপুণভাবে ঘটে গেল যে রানার বুঝতে অসুবিধে হলো না বহুদিনের অভ্যাসে একেবারে রপ্ত হয়ে গেছে প্রক্রিয়াটি ওদের। একেবারে সামনে থেকে না দেখলে কারও বোঝার উপায় নেই কি ঘটে গেল। কাল দুপুরে মেরিনোকে বয়াগুলোর কাছ ঘেষে এগোতে দেখে সন্দেহ হয়েছিল, কিন্তু রানাও বুঝতে পারেনি, জায়গামত বাক্সটা নামিয়ে দেয়াই ছিল ওটার আসল উদ্দেশ্য।