হঠাৎ মনের ভেতর থেকে সব ভয় দূর হয়ে গেল রানার। মুহূর্তে শান্ত, স্থির হয়ে গেছে ওর বুদ্ধিটা। মানুষের যখন আর কোন উপায় না থাকে তখন বোধহয় এইরকম অবস্থা হয়, শেষ মুহূর্তে উড়ে যায় ভয়ডর। একটা মাত্র রাস্তা খোলা আছে ওর সামনে, একেবেকে ঝেড়ে দৌড় দিল সে ওই রাস্তা ধরে। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বাচবার চেষ্টা করছে সে একেবেকে, লক্ষ্যভ্রষ্ট করবার চেষ্টা করছে আততায়ীর গুলি। প্রাণপণে ছুটছে রানা। আর পনেরো গজ, দশ গজ, পাঁচ গজ। সাইলেন্সড় গানের মৃদু শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে, মুহুর্মুহু–এতই কাছে এসে পড়েছে। বারদুয়েক হ্যাঁচকা টান লাগল ওর প্যান্টে, জ্যাকেটে। হঠাৎ পেছন দিকে বাকা হয়ে গেল রানার শরীরটা, আহত ভঙ্গিতে দুই হাত উঠল আকাশের দিকে, হাত থেকে পাইপের টুকরোটা ছুটে গিয়ে পড়ল পানিতে। সাথে সাথেই হুড়মুড় করে পড়ে গেল সে সামনের দিকে। মাতালের মত উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল রানা। বুকের বাম দিকটা। চেপে ধরে আছে দুইহাতে। দিশেহারার মত টালমাটাল দুই পা ফেলেই ঝপাৎ করে পড়ল সে পানিতে। পড়ার আগে লম্বা করে দম নিয়ে নিতে ভুলল না।
পানিটা ঠাণ্ডা, কিন্তু হাড় কাঁপানো নয়। ঘোলাটে। তিন সেকেন্ড পরই মাটি ঠেকল রানার পায়ে। বসে পড়ল রানা। ও জানে, এক্ষুণি গ্যাঙওয়ের শেষ মাথায় এসে দাঁড়াবে পশ্চাদ্ধাবনকারীরা, পানির দিকে চেয়ে বোঝার চেষ্টা করবে সত্যিই মারা গিয়েছে কিনা, পানির নিচটা দেখার চেষ্টা করবে টর্চ জ্বেলে। উপর থেকেই যেন ওরা সন্তুষ্ট হয়ে ফিরে যায় সেই চেষ্টা করতে হবে ওর। ততক্ষণ দম আটকে রাখতে পারলে হয়। কিন্তু যদি স্থির নিশ্চিত হওয়ার জন্যে কেউ পানিতে নামে, তাহলে ছুরি মেরে এখান থেকে ভেগে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না ওর। একহাজার এক, একহাজার দুই, একহাজার তিন–এইভাবে পনেরো পর্যন্ত শুনেই, অর্থাৎ ঠিক পনেরো সেকেন্ড পর মাথার উপর দেখতে পেল রানা আবছা আলো। ছোট দুটো ভুড়ভুড়ি ছাড়ল সে–অর্থাৎ, এই যে, এখানে আমি। আলোটা ঘুরছে মাথার উপর। বোধহয় রক্ত দেখা যায় কিনা খুঁজছে। আরও পনেরো সেকেন্ড পেরিয়ে গেল-রানার মনে হলো পনেরো মিনিট। এবার বড়সড় একটা বুদ্বুদ ছাড়ল রানা–অর্থাৎ দমটা বেরিয়ে গেল, বিশ্বাস করো–মরে গেছি।
কিন্তু সহজে বিশ্বাস করার পাত্র নয় ব্যাটারা। আরও প্রায় মিনিটখানেক আবছাভাবে দেখতে পেল রানা মাথার উপর চলন্ত আলো। মনে মনে প্রথমে ওদের, তারপর ওদের বাপ-মা, তারপর চোদ্দ গুষ্টি তুলে গাল দিল রানা, কিন্তু সেসব পাত্তা না দিয়ে ওরা বোধ হয় পানিতে নেমে দেখা উচিত কিনা তাই নিয়ে তর্ক করছে নিজেদের মধ্যে নিশ্চিন্তে। ফুসফুসটা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে রানার। হার্টবিট অনুভব করতে তো পারছেই, মনে হচ্ছে যেন শুনতে পাচ্ছে। দুই কানে তীক্ষ্ণ ব্যথা শুরু হলো। এখন যদি কেউ নিচে নেমে পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়, রবিউলের মত স্বাস্থ্য হলেও পারবে না রানা তার সাথে। সহ্যের যখন শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে রানা, তখনই নিবে গেল মাথার উপরের আবছা আলোটা। সাঁতার কাটতে শুরু করল রানা। ডানদিকে একটা বার্জের তলা হাতে ঠেকতেই বুঝতে পারল দিক ভুল হয়নি ওর। চট করে ওটার নিচ দিয়ে ওপাশে চলে গেল সে। তারপর অতি সন্তর্পণে ধীরে ধীরে ভেসে উঠল উপরে।
ফুঁপিয়ে উঠে শ্বাস নেয়া থেকে বহু কষ্টে বিরত রাখল রানা নিজেকে। হাঁ করে অল্প অল্প করে শ্বাস নিল নিঃশব্দে। অল্পক্ষণের মধ্যেই দম ফিরে পেয়ে নিঃশব্দে সাঁতার কেটে চলে এল সে বার্জের পেছন দিকটায়। গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে মানুষের। হালের আড়াল থেকে উঁকি দিল গ্যাঙওয়ের দিকে। তিনজন দাঁড়িয়ে আছে, রানা ঠিক যেখানটায় অদৃশ্য হয়েছে সেই জায়গায়। একজনের হাতে জ্বলন্ত টর্চ। ডানপাশের দুজনও আসছে এই দিকে সরু গ্যাঙওয়ে বেয়ে। এপাশে দাঁড়ানো তিনজনের মধ্যে সবচেয়ে লম্বাজন মাথা নাড়ল বারকয়েক, তারপর দুই হাত মাথার উপর তুলে ক্রসচিহ্ন দেখাল। ইঙ্গিতটা কার প্রতি পরিষ্কার বোঝা না গেলেও আন্দাজ করতে পারল রানা। ইঙ্গিতের সাথে সাথে কাছেই একটা ডিজেল এঞ্জিন স্টার্ট নেয়ার শব্দ শুনে। সিগন্যাল পেয়েছে বিশেষ একটা বাজের ক্যাপ্টেন। গ্যাঙিওয়ের তিনজন রওনা। হয়ে গেল পেছন দিকে। কাজ সমাধা হয়ে যাওয়ায় ব্যথাটা চেগিয়ে উঠেছে একজনের, খোঁড়াচ্ছে।
ছায়ামূর্তিগুলো অদৃশ্য হয়ে যাওয়া এবং চাঁদটা মেঘে ঢাকা পড়ার অপেক্ষায় তিন মিনিট ভেসে রইল রানা হাল ধরে, তারপর নিঃশব্দে, ব্রেস্টস্ট্রোক দিয়ে এগোল শব্দের উৎস লক্ষ্য করে। ক্রমেই বাড়ছে এঞ্জিনের গর্জন।
রানা যখন কাছাকাছি পৌঁছুল, ততক্ষণে গ্যাঙওয়ের সাথে বাধা কাছি খুলে ফেলা হয়েছে। এক্ষুণি পিছোতে শুরু করবে বার্জটা। রানা যখন ওটার গায়ের। কাছে পৌঁছুল, তখন ধীরে ধীরে পেছাতে শুরু করেছে ওটা। সমুদ্র থেকে বার্জের গা বেয়ে উপরে উঠে আসা শুনতে সহজ মনে হলেও আসলে প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। নাট-বল্ট আকড়ে ধরে দুবার চেষ্টা করল রানা আছড়ে পাছড়ে উপরে উঠে পড়বার, দুবারই হাত ফসকে পড়ে গেল আবার পানিতে। সড়সড় করে সরে চলে যাচ্ছে বার্জ পেছনদিকে। কোনদিক দিয়েই উপরে ওঠার কোন কায়দা পাচ্ছে না রানা। আশঙ্কা হলো, তবে কি এত কষ্ট, এত ঝুঁকি, সব বিফলে যাবে ওর? এতকিছুর পর একেবারে গায়ের কাছে এসে। ফসকে বেরিয়ে যাবে বার্জটা?