দশগজ যেতে না যেতেই ঘোমটা সরে গেল চাঁদের মুখ থেকে। ডাইভ দিয়ে শুয়ে পড়ল রানা, চিৎ হয়ে মাথাটা সামান্য একটু তুলে চেষ্টা করল ওদের গতিবিধি লক্ষ করতে। বামদিকের গ্যাঙওয়ে ফাঁকা। বোঝা যাচ্ছে, জীবিত লোকটার আত্মা কেঁপে গেছে চোখের সামনে সঙ্গীকে মৃত্যুবরণ করতে দেখে। মাঝের গ্যাঙওয়েতে যে দুজন ছিল, হুশিয়ার হয়ে গেছে তারাও, দেখা যাচ্ছে না–হয়তো সাবধানে বার্জের আড়ালে আড়ালে এগোচ্ছে সন্তর্পণে। ডানদিকে চেয়ে অগ্রসরমান দুই ছায়ামূর্তি দেখতে পেল রানা। বেশ খানিকটা। দূরে রয়েছে এখনও। হাঁটার দৃঢ় ভঙ্গি দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে কি ঘটে গেছে কিছুই জানে না ওরা। দেখে মনে হচ্ছে, রানার কাছে পিস্তল থাকতে পারে সে ভাবনার কথাও জানায়নি কেউ ওদের। কিন্তু জেনে নিতে বেশি সময় লাগল না। পরপর দুটো গুলি করল রানা। লাগল না একটাও, কিন্তু মুহূর্তে হাওয়া হয়ে গেল ওরা। এইবার শুরু হলো আসল লুকোচুরি খেলা। ওদের থমকে দিয়ে রানা চাইল যত শিগগির সভব সামনে এগিয়ে যেতে। পরবর্তী পাঁচটা মিনিট ধরে খণ্ড খণ্ড মেঘের ছায়ার সুযোগ নিয়ে ছুটল রানা, মেঘের আবরণ সরে যাওয়ার আগেই দাঁড়াল কোনকিছুর আড়ালে, একটা দুটো গুলি ছুঁড়ল পেছন দিকে, ছায়া পেয়ে ছুটল আবার। ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে এল ওর কাছে যে এভাবে আর বেশিক্ষণ চলতে পারে না। অনেক কাছে চলে এসেছে ওরা, তিনদিক থেকেই কমিয়ে আনছে দূরত্ব। ঝুঁকি নিচ্ছে না, সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কাজে লাগাচ্ছে কৌশলে। একজন বা দুজন ধরে রাখছে রানার মনোযোগ, সেই সুযোগে বাকি কজন এগিয়ে আসছে এক বার্জের আড়াল থেকে আরেক বার্জের আড়ালে। পরিষ্কার বুঝতে পারল রানা, এক্ষুণি অন্য ধরনের কোন কৌশল যদি বের করতে না পারে, তাহলে কিছুক্ষণের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে এই লুকোচুরি খেলা। বড়জোর আর পাঁচটা মিনিট ঠেকাতে পারবে সে ওদের।
মানসপটে সোহানা আর মারিয়ার মুখ ভেসে উঠল। সত্যিই কি বিশেষ কোন ক্ষমতা রয়েছে মেয়েদের মধ্যে? নইলে অমন উদ্ভট ব্যবহার করে বসল। কেন আজ একসাথে দুজন? সত্যিই কি রানার অমঙ্গল টের পেয়েই বারণ করছিল ওরা আজ রাতে বেরোতে? আজকের রাতের বিশেষ গুরুত্ব জানা নেই ওদের, সেজন্যই অত চাপাচাপি করছিল ওরা। আজ না এলে তিনমাসের জন্য পিছিয়ে যেত রানার কাজ। কি যেন উত্তর দিয়েছিল সে। মারিয়াকে?–লাক ইজ ইনফ্যাচুয়েটেড উইথ দ্য এফিশিয়েন্ট। বাহ! চমৎকার এফিশিয়েনসি দেখাচ্ছে সে। ও আশা করেছিল বিপদ আসবে, কিন্তু কল্পনাও করতে পারেনি, এই ধরনের বিপদ ঘটতে পারে। ভেবেছিল, অন্ধকার ছায়ায় লুকিয়ে থাকবে একজন নীরব পিস্তলধারী, কিংবা কোন নাইফ এক্সপার্ট–তাকে কৌশলে বাগে আনতে বেশি অসুবিধে হবে না। ছয়জন মিলে যে ওকে কুকুর তাড়ানো তাড়াবে, ভাবতেও পারেনি সে। সোহানাকে বলেছিল সে, যে লোক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে প্রাণ নিয়ে পালাতে পারে সে আরেকবার যুদ্ধের সুযোগ পায়। কিন্তু পালাতে পারলে তো ফের যুদ্ধের প্রশ্ন! পালাবার রাস্তা চোখে। পড়ল না রানার। বিশ.গজ গিয়েই শেষ হয়ে গিয়েছে মেইন গ্যাঙওয়ে। সত্যিই কি মারা যাচ্ছে ও আজ?
মাথা ঝাড়া দিয়ে বাজে চিন্তা দূর করে দিল রানা। ভাল করেই জানা। আছে ওর, জীবন-মৃত্যু এখন ওর নিজের হাতে। শুধু সাইলেন্সরটা খুলে আকাশের দিকে দুটো গুলি ছুঁড়লেই মুহূর্তে জেগে উঠবে এই বার্জ-বন্দরের শত শত নাবিক, দপ করে জ্বলে উঠবে দশ বারোটা সার্চলাইট, ওকে আর কুকুরের মত গুলি করে মারতে পারবে না শিকারিরা, নিজেরাই পালাবে লেজ তুলে। কিন্তু এই মুহর্তে কাজটা করলে এতদিনের পরিশ্রম, এত অর্থব্যয়, এত কষ্ট, সব, ভেস্তে যাবে। আজ রাতের পর আর কোনদিন কোন সুযোগ পাবে না রানা-ব্যর্থতা নিয়ে ফিরে যেতে হবে ওকে মাথা নিচু করে বাংলাদেশে। জীবনে কোনদিন চোখ তুলে চাইতে পারবে না সে মেজর জেনারেল রাহাত খানের চোখের দিকে। নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে হলেও শেষ চেষ্টা করে দেখতে হবে ওর। প্রাণের ভয়ে বানের জলে ভাসিয়ে দিতে পারে না ও সবকিছু।
প্ল্যান ঠিক করে ফেলল রানা। পাগলামি। কিন্তু তাড়া করলে ভাল মানুষও পাগলা কুকুর হয়ে যায়। এর চেয়ে ভাল কিছু মাথায় খেলল না ওর। ঘড়ি দেখল। ছয় মিনিট বাকি দুটো বাজতে। সবদিক থেকেই ফুরিয়ে এসেছে সময়। আকাশের দিকে চাইল। ছোট একটা মেঘ ভেসে আসছে চাঁদের দিকে। বড়জোর এক মিনিট ঢাকা থাকবে চাঁদটা। পরিষ্কার বুঝতে পারছে রানা, এই একটি মিনিট ব্যবহার করবে ওরা রানাকে খতম করে দেয়ার জনে–এটাই শেষ আক্রমণ। কাজেই এই একটি মিনিটের মধ্যে বাচবার শেষ চেষ্টা করতে হবে রানার। ডেকের চারপাশে চেয়ে দেখল রানাঃ এ বার্জের কারগো পরানো লোহালক্কড। দশ ইঞ্চি লম্বা একটুকরো জি.আই. পাইপ তুলে। নিল সে হাতে। আবার চাইল ঘন কালো মেঘের টুকরোটার দিকে–যতটা ভেবেছিল, তার চেয়েও ছোট মনে হলো মেঘটাকে। কয়েক সেকেন্ড চেয়ে। থেকে টের পেল ওটার পেটটা ঠিক চাঁদের নিচ দিয়ে যাবে না, বেশ কিছুটা ডাইনে সরে এগোচ্ছে ওটা–একপাশ দিয়ে ঢাকা পড়বে চদি অল্পক্ষণের জন্যে। যাইহোক, যেটুকু সময় পাওয়া যায় তাই কাজে লাগাতে হবে ওর এখন।
দ্বিতীয় ম্যাগাজিনের পাঁচটা গুলি রয়ে গেছে, অনুসরণকারীদের মোটামুটি অবস্থান লক্ষ্য করে আন্দাজে গুলি করল সে পরপর পাঁচবার। আশা করল, এর ফলে ওরা যদি কয়েক সেকেন্ডের জন্যে নিরুৎসাহিত হয় সেটাও লাভ। পিস্তলটা চট করে প্লাস্টিকের ব্যাগে পুরে জিপ লাগিয়ে পকেটে ফেলল রানা। তিন লাফে চলে এল বার্জের কিনারায়। গ্যাঙওয়ের পাঁচফুট দুরে। লাফিয়ে। পড়ল গ্যাঙওয়ের উপর, আছড়ে পাছড়ে উঠে দাঁড়াতেই টের পেল, মেঘের বাচ্চা পুরোপুরিই মিস্ করেছে চাঁদটাকে।