চওড়া গ্যাংওয়ে বেয়ে তিনভাগের এক ভাগ যেতে না যেতেই ফিক করে হেসে উঠল চাঁদটা। থমকে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরল রানা।
পেছন থেকে নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে দুজন লোক। পঞ্চাশ গজ দুরে। ছায়ামত সিলয়েট দেখা যাচ্ছে ওদের, কিন্তু এতদূর থেকেও টের পেল রানা বাম হাতের চেয়ে ওদের দুজনেরই ডানহাত বেশ খানিকটা বেশি লম্বা। কিছু একটা বয়ে আনছে ওরা ডানহাতে করে।
নড়াচড়ার আভাস পেয়ে চট করে ডানপাশে চোখ গেল রানার। ডানদিকের সমান্তরাল গ্যাঙওয়ে বেয়ে সন্তর্পণে এগিয়ে আসছে আরও দুজন লোক। এদেরও ডান হাত বেশি লম্বা। এই গ্যাঙওয়ের লোক দুজনের চেয়ে এরা কয়েক গজ এগিয়ে আসছে।
বামদিকে দৃষ্টি ফেরাল রানা। আরও দুজন। বাম পাশের গ্যাঙওয়েতে আরও দুটো জলন্ত ছায়ামূর্তি। মনে মনে এদের নিখুঁত সমন্বয়-জ্ঞানের প্রশংসা না করে পারল না রানা। প্রফেশনাল। চট করে ঘুরে পা বাড়াল সে সামনের দিকে।
চলতে চলতেই পকেট থেকে প্লাস্টিকের ব্যাগ বের করে জিপার খুলে বের করল রানা পিস্তলটা। সাইলেন্সর সিলিন্ডার পেচিয়ে নিল পিস্তলের মুখে। ওরও ডান হাতটা লম্বা হয়ে গেল বাম হাতের চেয়ে। চাঁদটা ঢাকা পড়ল। মেঘের আড়ালে। দৌড়াতে শুরু করল রানা। ঘাড় ফিরিয়ে দেখল। অনুসরণকারীরাও দৌড়াচ্ছে। কয়েক গজ গিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে আবার চাইল। রানা পেছন দিকে। রানার ঠিক পেছনের দুজন থেমে দাঁড়িয়েছে। পিস্তল তাক করছে কিনা প্রথমটা বোঝা গেল না, পরমুহূর্তে ছোট্ট দুটো লাল স্ফুলিঙ্গ দেখে। নিঃসন্দেহ হলো রানা ওদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে। কোন আওয়াজ নেই। কয়েকশো বাজে ঘুমন্ত বেপরোয়া সাহসী জার্মান, ডাচ, বেলজিয়ান নাবিকদের। ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে বিপদে পড়তে চায় না ওরা। কাজ সারতে চাইছে নীরবে। মেঘের আচ্ছাদন সরে যেতেই আবার রুগ্ন হাসি দেখা দিল চাঁদের মুখে। আবার দৌড় দিল রানা। একেবেঁকে।
জ্যাকেটের হাতায় টান পড়ল, জ্বলে উঠল রানার ডান হাতটা, বাইসেপের কাছে। চামড়া খানিকটা চিরে দিয়ে বেরিয়ে গেছে গুলিটা। আর। ঝুঁকি নেয়া উচিত হচ্ছে না বুঝতে পেরে সাই করে পাশ ফিরল রানা, একলাফে উঠে পড়ল সরু গ্যাঙওয়ের সাথে ভেড়ানো মাঝারি আকারের। বার্জের ডেকে, ছুটে গিয়ে দাঁড়াল হুইলহাউজের আড়ালে। মাথাটা সামনে বাড়িয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে চাইল অনুসরণকারীদের দিকে।
রানার ঠিক পেছনের লোক দুজন, অর্থাৎ মাঝের অনুসরণকারী দুজন থেমে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে এগিয়ে যাওয়ার জন্যে ইশারা করছে দুপাশের লোকদের। আগে বেড়ে ঘিরে ধরতে পারলে সহজেই খতম করে দেয়া যাবে। রানাকে। ঘিরে ফেলতে চাইছে রানাকে। সত্যিই যদি সফল হয়, কাবু করে। ফেলতে বেশি সময় লাগবে না ওদের।
লোকগুলোর মধ্যে স্পোর্টসম্যান স্পিরিটের অভাব দেখে অত্যন্ত দুঃখ হলো রানার। তার চেয়ে বেশি হলো ভয়। কারণ খেলোয়াড়সুলভ না হলেও পদ্ধতিটা যে অত্যন্ত কার্যকরী, তাতে রানার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। যেমন করে হোক ওদের এই ঘিরে ফেলাটা বন্ধ করতে না পারলে কয়েক মিনিটের মধ্যে সমুদ্রের নিচে ডুবিয়ে দেয়া হবে ওর লাশটা পাথর বেধে।
মাঝের গ্যাঙওয়ের লোক দুজন আপাতত বিপজ্জনক নয়, বুঝতে পারল রানা। ওরা সামনে এগোবার চেষ্টা না করে পাশের লোকদের সামনে বেড়ে ঘিরে ধরবার অপেক্ষা করবে, তারপর পেছন থেকে গুলি করবার সুবিধের। জন্যে রানার, মনোযোগ সামনের দিকে আটকে রাখবার চেষ্টা করবে। বামদিকের লোকগুলোর অবস্থান বোঝার জন্যে ঘাড় ফেরাল রানা।
ঠিক পাঁচ সেকেন্ড পর দেখতে পেল রায় ওদের। অনেকটা কাছে চলে এসেছে। দৌড়াচ্ছে না এখন, হাটছে সন্তর্পণে, বার্জগুলোর হুইলহাউজ আর কেবিনের ছায়ায় খুঁজছে রানাকে। গুলি করল রানা। প্রায় নিঃশব্দে এলোপাতাড়ি কয়েক পা ফেলে ঢলে পড়ল, ছোট্ট একটা ছপাৎ শব্দ তুলে তলিয়ে গেল একজন সাগর গর্ভে। প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে ওর আগেই। আবার গুলি করবার আগেই একলাফে সরে গেল দ্বিতীয় লোকটা পিস্তলের সামনে থেকে, এতই দ্রুত…যেন সাক্ষাৎ ভূত দেখতে পেয়েছে সামনে।
আবার মাঝের লোক দুজনের দিকে চাইল রানা। যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছে ওরা। এদিকে কি ঘটে গেছে হয়তো টেরই পায়নি। বেশ অনেকটা দূরে পিস্তলের রেঞ্জের বাইরে রয়েছে এরা দুজন। বিশেষ করে আবছা আধারে লক্ষ্যভেদ করবার পক্ষে বহুদূর। তবু সময় থাকতে ওদের একটু দমিয়ে দেয়ার প্রয়োজনে একটু সময় নিয়ে লক্ষ্যস্থির করল রানা। চমকে ওঠার ভঙ্গি করল ওদের একজন, অস্ফুট একটা আওয়াজ কানে এল রানার। খুশি হয়ে উঠতে যাচ্ছিল রানা, কিন্তু সঙ্গীর পেছন পেছন লোকটাকে বিদ্যুৎবেগে লাফ দিয়ে গ্যাঙওয়ে ছেড়ে একটা বার্জের কেবিনের পেছনে আশ্রয়। নিতে দেখে বুঝলি গুরুতর কিছুই নয়, সামান্য জখম করতে পেরেছে সে বড়জোর। মেঘে ঢাকা পড়ল আবার চাঁদটা। ছোট্ট মেঘ। কিন্তু আগামী দুতিন। মিনিটের মধ্যে চাঁদকে আড়াল করবে, কাছেপিঠে সে রকম আর কোন মেঘ দেখতে পেল না রানা, কাজেই এটারই সদ্ব্যবহার করতে হবে যতটা পারা। যায়। ওর অবস্থান জানা হয়ে গেছে শত্রুপক্ষের, এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। তিন লাফে আবার গ্যাঙওয়েতে উঠে এল সে, খিচে দৌড় দিল সামনের দিকে।