কার্লটন হোটেলে ফিরে এল রানা সন্ধের পরপরই। খেয়ে নিল সকাল সকাল। অ্যালার্মের কাটা ঠিক সাড়ে বারোটার উপর এনে খাপ বন্ধ করে। ঘড়িটা ঢুকিয়ে দিল সে বালিশের নিচে। তারপর শুয়ে পড়ল টানটান হয়ে। মন থেকে সমস্ত উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, আশঙ্কা, দূর করে দিতে দুমিনিটের বেশি লাগল ওর। তৃতীয় মিনিট পার হওয়ার আগেই তলিয়ে গেল সে অতল গভীর ঘুমে।
ডানহাতটা রয়েছে ওর বালিশের পাশে রাখা পিস্তলের বাঁটে।
.
০৪.
ঘড়ির অ্যালার্ম বেজে উঠতেই শিকারি বিড়ালের মত চোখ মেলল রানা। নিঃশব্দে উঠে পড়ল বিছানা থেকে। কাপড় পরতে পরতে কেমন যেন সুড়সুড়ি জাতীয় অনুভূতি হলো ওর পাকস্থলীতে–অনিশ্চিত জানার পথে পা বাড়াতে হলে হয় ওর এরকম। নেভি রোল-নেক, জাম্পারের উপর গাঢ় ছাইরঙের ক্যানভাস জ্যাকেট চাপাল, পায়ে ক্যানভাসের হকি কেডস্। একটা জিপ লাগানো প্লাস্টিকের ব্যাগে পিস্তল, সাইলেন্সর আর দুটো স্পেয়ার ম্যাগাজিন পূরে ঢুকিয়ে দিল জ্যাকেটের পকেটে। তৈরি হয়ে নিয়ে নেমে এল সে রাস্তায় ফায়ার এসকেপের সিঁড়ি বেয়ে। সরু গলিতে জনপ্রাণীর চিহ্ন দেখা গেল না কোথাও।
নিরাপদেই পৌঁছুল রানা গাড়ি পর্যন্ত। কেউ অনুসরণ করবার চেষ্টা করল না ওকে। ওর উপর নজর রাখবার দরকার বোধ করছে না, আর কেউ কাল সন্ধে থেকে। কেন? এর একমাত্র কারণ, রানার গতিবিধি সম্পর্কে অন্য কোন উপায়ে পূর্ণ ওয়াকিফহাল থাকছে শত্রুপক্ষ। বারণ করে দেয়া হয়েছে অনুসরণকারীদের। আজকে তো বিশেষ করে বারণ করা হবে যেন কোনভাবে। বিরক্ত করা না হয় রানাকে। আজ ওরা জানে কোথায় চলেছে রানা। পরিষ্কার। জানে রানা, ওরা জানে আজ কোথায় পাওয়া যাবে, রানাকে। মনে মনে কামনা করল, রানাও যে জানে যে ওরা জানে, সেটা ওরা না জানলেই ভাল হয়।
হাঁটবার সিদ্ধান্ত নিল রানা। গাড়িটা রেখে এসেছে বিকেলে হাইলার দ্বীপ থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে। ট্যাক্সির প্রতি কেমন একটা অবিশ্বাস জন্মে গেছে ওর, কাজেই ট্যাক্সিও নেবে না। অলিগলি বেয়ে এগোল সে লম্বা পা ফেলে। সাইড স্ট্রীটগুলোতে লোক চলাচল কমে এসেছে অনেক। প্রশান্ত একটা ভাব বিরাজ করছে শহরের এই অঞ্চলটায়।
ডক এরিয়ায় পৌঁছে প্রথমে নিজের অবস্থানটা ভালমত বুঝে নিল রানা। কোনদিক দিয়ে কোনদিকে গেলে গন্তব্যস্থলে পৌঁছুতে পারবে বুঝে নিয়ে দ্রুত পা ফেলে বার্জ-বন্দরের পাশে একটা ঢেউটিনের গুদামঘরের গাঢ় ছায়ায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। ঘড়ির উজ্জ্বল ডায়ালের দিকে চাইল। দুটো বাজতে বিশ। বিকেলের চেয়ে আর একটু বেড়েছে. বাতাসের বেগ, আরও শীতল হয়েছে। বৃষ্টি যদিও পড়ছে না, বাতাসে আর্দ্র একটা ভাব টের পেল রানা। পৃথিবীর সমস্ত জেটির ধারে সমুদ্র, আলকাতরা, ডিজেল, রশি ইত্যাদি আরও অনেক কিছুর গন্ধ মিশে যে অদ্ভুত একটা স্মৃতি জড়ানো তীব্র গন্ধ নাকে আসে, সেই পরিচিত গন্ধ ছাপিয়েও আবছাভাবে রানার নাকে এল বৃষ্টির ভেজা ভেজা। আগাম-গন্ধ। চট করে চোখ গেল ওর আকাশের দিকে। প্রায় মাঝআকাশে, উঠে পড়েছে কৃষ্ণপক্ষের ভাঙা চাঁদ। খণ্ড খণ্ড মেঘ ছুটে বেড়াচ্ছে আকাশময়, মাঝে মাঝে ঢাকা পড়ছে চাঁদটা, খানিক বাদেই আবার হাসছে রোগাক্রান্ত মান হাসি। চাঁদ ঢাকা পড়লেও পুরোপুরি অন্ধকার হচ্ছে না, কারণ খণ্ড মেঘের ফাঁকে সারা আকাশ জুড়েই রয়েছে উজ্জ্বল তারার ঝালর।
বন্দরের দিকে দৃষ্টি বোলাল রানা। কিছুদুর বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। তারপর আবছা, তার ওপাশে অন্ধকার। কয়েকশো বার্জ দাঁড়িয়ে আছে। এলোমেলো ভঙ্গিতে। কোনটা ছোট্ট বিশ-ফুটি, কোনটা বিশাল জাহাজের সমান। আসলে ওগুলোর দাঁড়াবার ভঙ্গিটাই শুধু এলোমেলো, হ্যাঁভেঞ্জবো। স্কাইস্ক্র্যাপারের অবজার্ভেশন প্ল্যাটফর্ম থেকে বিনকিউলার দিয়ে ভালমত পরীক্ষা করে দেখছে রানা, বেরোবার রাস্তা রাখা আছে–প্রত্যেকটা বার্জ ইচ্ছে করলেই অলিগলি বেয়ে খোলাসমুদ্রে গিয়ে পড়তে পারে। ঠাসাঠাসি ভিড়ের মধ্যেও একটা নিয়ম-শৃঙ্খলা রক্ষা করা হয়েছে। বাজগুলো ভেড়ানো। রয়েছে সারি সারি ফ্লোটিং গ্যাঙওয়ের গায়ে। তীর থেকে লম্বালম্বি সমান্তরালভাবে সাগরের দিকে চলে গেছে চওড়া গ্যাঙওয়ে, প্রত্যেকটা আবার বিশগজ অন্তর অন্তর সরু গ্যাঙওয়ে দিয়ে পরস্পরের সাথে জোড়া।
চাঁদটা মেঘে চাপা পড়তেই দ্রুতপায়ে এগোল রানা, একটা চওড়া গ্যাঙওয়ের দিকে। নিঃশব্দে। অবশ্য রাবার সোলের জুতো না পরে যদি আমি বুট পায়ে দিত তবু এখানে ওর আগমন কেউ টের পেত কিনা সন্দেহ। যদিও প্রত্যেকটা বার্জেই অন্তত কয়েকজন করে লোক আছে, এতগুলো বার্জের মধ্যে শুধু দুটো কি তিনটে কেবিন থেকে দেখা যাচ্ছে আলোর রশ্মি। কোথাও টু শব্দ নেই মানুষের। বাতাসের মৃদু গোঙানি, বোটগুলোর খোল ঢেউয়ের মৃদু চাপড়, মাঝে মধ্যে কাঠে কাঠে ঘষা লেগে ক্যাচকঁচ আওয়াজ–সব মিলে। নীরবতাকে আরও গভীর করে তুলেছে। ঘুমনগরী বলে মনে হচ্ছে। এলাকাটাকে, মায়াবিনীর যাদু যেন ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে এখানকার সবাইকে। শত্রুপক্ষের কথা আলাদা। রাবার সোল কেন, তুলোর সোল পায়ে দিয়ে এলেও টের পাবে ওরা হয়তো পেয়ে গেছে এতক্ষণে। চারপাশে চেয়ে নিয়ে চলার গতি দ্রুততর করল রানা।