কি আছে তাতে? তুমি তো জানো আমাকে, সোহানা। তুমি…
থেকে যাও, প্লীজ! রানা! মারিয়া ঠিকই বলেছে। ভয়ানক অশুভ কিছু ঘটতে চলেছে আজ রাতে।
হ্যাঁ, কথাটা একটু ঘুরিয়ে নিল মারিয়া। সোহানা বলতে চায়, আমাদেরও তো কিছু অমঙ্গল ঘটে যেতে পারে। আজ রাতটা থেকে যান আমাদের সাথে।
তুমি একা হলে সানন্দে রাজি হয়ে যেতাম, মারিয়া, মৃদু হেসে বলল রানা। কিন্তু দুজনকে দুপাশে নিয়ে ঘুমোতে আমার খুব লজ্জা লাগে। তাছাড়া সোহানাটা দারুণ পাজি, হয়তো তোমার দিকে পাশ ফিরতেই দেবে। সারারাত, তার ওপর দেশে ফিরে যা-তা রটাবে তোমার-আমার নামে।
এসব কথায় হাসি এল না ওদের কারও মুখে। হাল ছেড়ে দিল সোহানা। হাত ধরে টানল মারিয়ার।
ওকে কিছু বলে লাভ নেই, মারিয়া। তার চেয়ে একখণ্ড পাথরের সাথে কথা বলা বরং ভাল। সিদ্ধান্ত নিয়েছে যখন, ঠেকানো যাবে না ওকে, ও যাবেই।
কথাটা বলেই উঁচু হয়ে চট করে একটা চুমু খেলো সোহানা রানার গালে, দেখাদেখি মারিয়াও তাই করল রানার আরেক গালে। বিরক্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল রানা এপাশ-ওপাশ।
দেখো, বসের সাথে এরকম ব্যবহার করাটা খুবই অন্যায়। এসব ডিসিপ্লিনের জন্যে খুব ক্ষতিকর। ভবিষ্যতে এই ধরনের দুর্বলতা তোমাদের পরিহার করবার চেষ্টা করা উচিত। বসের গালে চুমো খাওয়া কি?
গজর গজর করতে করতে বেরিয়ে গেল রানা আর কাউকে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে।
নিজের হোটেলে ফেরার পথে দুইশীট বাউন পেপার আর কিছু সুতো কিনে নিল রানা। ঘরে ঢুকে একসেট জামাকাপড় সুন্দর করে ভাজ করে। পেপার মুড়ে প্যাকেট তৈরি করল একটা। প্যাকেটের উপর যা-তা আবোল তাবোল নাম-ঠিকানা লিখে নিয়ে তরতর করে নেমে এল নিচে। ডেস্কে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেই অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার।
পোস্ট অফিসটা কোনদিকে হবে বলুন তো? জিজ্ঞেস করল রানা।
একগাল হাসল অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার, নাম-ঠিকানা লেখা প্যাকেটটা দেখল। এসব কাজ আমাদের ওপর নিশ্চিন্তে চাপাতে পারেন, মিস্টার মাসুদ রানা।
তা তো নিশ্চয়। কিন্তু আপাতত আপনাদের কষ্ট না দিয়ে এটা নিজের হাতে পোস্ট করতে চাই।
ও, আচ্ছা বুঝতে পেরেছি। বলল লোকটা। রানা মনে মনে বলল কচু বুঝেছিস শালা। আসল ব্যাপার, ও চায় না বগলের নিচে প্যাকেট নিয়ে। ওকে হোটেল থেকে বেরোতে দেখে কেউ অতিরিক্ত কৌতূহলী হয়ে উঠুক। পোস্ট অফিসের ঠিকানা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল রানা।
পুলিসকারের বুটে কাপড়ের প্যাকেটটা রেখে সোজা উত্তর দিকে গাড়ি হাকাল রানা। শহর ছাড়িয়ে চলে এল শহরতলিতে, তারপর আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে চলল গ্রামের দিকে। রাস্তার ডানদিকে উঁচু পাড় থাকায় দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ঘণ্টাখানেক পরই অনুভব করতে পারল রানা, সমুদ্রের ধার ঘেঁষে এগোচ্ছে সে এখন। বেশিদূর নেই আর হাইলার দ্বীপ। রাস্তার বামদিকে মাইলের পর মাইল নিচু জমি দেখা যাচ্ছে–সী-লেভেল থেকেও বেশ খানিকটা নিচু। প্রকৃতির সাথে কঠোর সংগ্রাম করে এরা নিজেদের অস্তিত্ব কেবল টিকিয়ে রেখেছে তাই নয়, দুনিয়াতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বীর জাতি হিসেবে, ভাবতে গিয়ে শ্রদ্ধাবোধ জাগল ওর অন্তরে। অনেক আগেই এদের হারিয়ে যাওয়ার কথা সাগরের তলে। ডাইক বেধে ঠেকিয়ে দিয়েছে ওরা। শত্রুকে, বেড়ি দিয়েছে সমুদ্রের পায়ে।
একটা সাইনপোস্টে রানা দেখল হাইলার আর পাঁচ কিলোমিটার। কয়েকশো গজ গিয়েই বয়ে একটা সরু রাস্তা পেয়ে সেই পথ ধরে চলে গেল। আরও কয়েকশো গজ। ছোট্ট একটা গ্রাম। পোস্ট অফিস আছে, পাবলিক টেলিফোন বুদও দেখা যাচ্ছে একটা সাথেই লাগানো। পোস্ট অফিসের সামনে পার্ক করে গাড়ি ছেড়ে নেমে পড়ল রানা, দরজা আর বুট লক করে। দিয়ে রওনা হয়ে গেল মেইন রোডের দিকে।
বড় সড়কে পৌঁছে রাস্তা পেরিয়ে ডাইক বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করল সে। ঘাস বিছানো ঢাল বেয়ে উপরে উঠেই দেখতে পেল সেসমুদ্র। নীল জলে। শেষ বিকেলের রোদ পড়ে আশ্চর্য মায়াময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। বেশ জোর। একটা শিরশিরে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে সমুদ্র থেকে ডাঙার দিকে। বহুদূরে কালো একটা রেখার মত দেখা যাচ্ছে বকা তীর। তার ওপাশে জমির কোন চিহ্ন দেখা যায় না। এখান থেকে একমাত্র দর্শনীয় বস্তু হচ্ছে উত্তর-পূর্বদিকের মাইলখানেক দূরের একটা দ্বীপ।
এরই নাম হাইলার দ্বীপ। যদিও পুরোপুরি দ্বীপ বলা যায় না একে। এককালে এটা দ্বীপ ছিল, কিন্তু কারিগরি উন্নতির যুগে ওটাকে আর আলাদা থাকতে দেয়নি এদেশের প্রেকৌশলীরা। মেইনল্যান্ড থেকে উঁচু করে পাথরের বাঁধ তৈরি করে নিয়ে গেছে ওই দ্বীপে। বাধের উপর দিয়ে টারম্যাকারে চমৎকার হাইওয়ে। আদি দ্বীপবাসীদের অদ্ভুত আচার-আচরণ, পোশাক পরিচ্ছদ আর লোকনৃত্য দেখতে প্রতিবছর অসংখ্য ট্যুরিস্ট আসে এখানে। বাধের খরচ উঠে গেছে কবে!
এখান থেকে দেখে অবশ্য তেমন কিছু মোহিত হওয়ার কারণ খুঁজে পেল রানা। দেখে মনে হচ্ছে এত নিচু যে দশ ফুট উঁচু একটা ঢেউ এলেই ভাসিয়ে নিয়ে যাবে বাড়ি-ঘর, খামার, হাট-বাজার, সব। বেশির ভাগই ধু-ধু করছে মাঠ, মাঝে মাঝে এক আধটা খামার বাড়ি, সোলা। দ্বীপের পশ্চিম দিকে মুখ করে গড়ে উঠেছে একটা ছোটখাট মফঃস্বল শহর। ওপাশে বন্দরের একাংশও দেখা যাচ্ছে এখান থেকে। দ্বীপের বুকে বেশ কয়েকটা ক্যানেল চকচক করছে। যা দেখবার দেখে নিয়ে আবার রাস্তায় নেমে এল রানা। গজ পঞ্চাশেক এগিয়েই পেয়ে গেল বাসস্ট্যান্ড। একটা সিগারেট শেষ হওয়ার আগেই শহরগামী বাস পেয়ে উঠে পড়ল সেটায়।