বলাবাহুল্য ময়না হোস্টেল ছেড়ে দিলো। ওর সৌভাগ্যে সত্যিই অনেকে ঈর্ষাকাতর হলো। চারমাস পর হারুনকে কোম্পানি থেকে একটা ব্যবসায়িক ট্যুরে ইউরোপের কয়েকটা দেশে পাঠালো। ময়নাও দু’মাসের ছুটি নিয়ে মহানন্দে হারুণের সঙ্গী হলো। কতো দেশ দেখলো, কতো লোকের সঙ্গে পরিচয় হলো, কতো শপিং করলো সবার জন্যে। কিন্তু পথে চলতে চলতে হঠাৎ করে একটা মুখকে কেমন যেন পরিচিত মনে হয়। ময়না ভীত বিহ্বল হয়ে পড়ে। তারপর আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়। হারুন লক্ষ্য করেছে তবে এ নিয়ে ওকে কিছু বলে নি। ভাবে সময় মতো সব ঠিক হয়ে যাবে। ময়না ভাবে দেশে ফিরে গিয়ে এবার সে একটা সন্তান চাইবে হারুণের কাছে। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। মানুষ করে রেখে যেতে হবে তো।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের খবর ওদের কানে পৌঁছালো পর দিনই। দুজনেই ভীষণভাবে বিচলিত। ময়নার কান্না থামাতে পারে না হারুন। ও শুধু বলছে, বাবা তোমার জন্যে সব দিলাম, তবুও তোমাকে রাখতে পারলাম না। হারুন আমি টাকা যাবো, বাড়ি যাবো। শেষ পর্যন্ত ডাক্তার ডেকে ওকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হলো। না, পরদিন সকালে ওকে সুস্থ মনে হলো তবে কিছুটা দুর্বল। হারুন তার নির্ধারিত কাজে বেরিয়ে গেল, ময়না সারাদিন বিশ্রামই নিলো।
সফর শেষ করে সেপ্টেম্বরে দেশে ফিরে এলো ওরা। বাইরে খুব একটা পরিবর্তন চোখে পড়ল না কিন্তু সর্বত্রই যেন একটা ভয় এটা শংকা। বঙ্গবন্ধুর কিছু ঘনিষ্ঠ সাথী কেউ স্বেচ্ছায় কেউ বাধ্য হয়ে মুস্তাক মন্ত্রীসভায় যোগ দিলেন। জেলে গেলেন তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান ও আরও বহু আওয়ামী লীগ নেতা কর্মী। ময়নাকে আবার পুরোনো ভয় পেয়ে বসেছে। হারুন কার সঙ্গে পরামর্শ করবে বুঝে পায় না। সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো দরকার কিন্তু পুরোনো গণ্ডির মাঝে ময়নাকে ফেলতে তার সাহস হয় না। আস্তে আস্তে ময়না স্বাভাবিক হলো। অফিসে যায় আসে তবে বাইর বিশেষ যেতে চায় না। একটা সুখবর অন্তঃসত্ত্বা হলো ময়না। সবাই খুশি বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি। হারুন চায় মেয়ে আর ময়না অসম্ভব জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে না ছেলে’। মেয়ে আমি চাই না। অপ্রত্যাশিত না হলেও আরেকটা ধাক্কা এলো নভেম্বরে।
খালেদ মোশারফসহ আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধা নিহত হলেন। পথে হঠাৎ করে নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবর, শোনা গেল। হারুন বড় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো ময়নার জন্য। কিন্তু না এবার সে ভবিষ্যত মাতৃত্বের আনন্দে ও কল্পনায় বিভোর। বাইরের হুজুগ, চার নেতার মৃত্যু তাকে আঘাত করলো বলে মনে হয় না। শুধু মাঝে মাঝে বলতে কি যে হবে, কি যে হবে তাই ভাবি।
সন্তান ভূমিষ্ট হলো। পুত্রসন্তান, হারুন নাম রাখলো গৌতম। ময়না হেসে সম্মতি দিলো। অবশ্য দু’তরফ থেকে ডজন খানেক নামকরণ হয়ে গেল। তিন মাসের ছুটি। ময়নার মা এসে সঙ্গে আছেন। শাশুড়ি মাঝে মাঝে আসেন কিন্তু থাকতে পারেন না। হঠাৎ করে একদিন ময়না আবিষ্কার করলো, ইদানীং হারুণের মুখ যেন কিছু মলিন, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। জিজ্ঞেস করলে বলে না না, ও কিছু না। তুমি আমাকে নিয়ে বেশি ভাবো কিনা। একটু মনোযোগ দাও নিজের দিকে। কিন্তু ময়নার চোখ ফাঁকি দিতে পারে না। শেষ পর্যন্ত ময়নাকে বলে, কারা যেন টেলিফোনে প্রায়ই ওকে ভয় দেখায়। ময়নাকে নিয়ে যা তা কথা বলে। মুক্তিযোদ্ধার ওস্তাদী ওরা শেষ করে দেবে। ময়না উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে, তুমি থানায় একটা ডায়েরি করে রাখো। অবশ্য সাহস থাকলে সামনে আসতো। যতো সব ভীতুর দল। এ নিয়ে তুমি মন খারাপ করো না। কি করবে আমাদের? না ময়না, করতে ওরা সবই পারে। ‘৭১-এ দেখেছো এদের চেহারা, এদের চরিত্র। তাই একেবারে উপেক্ষা করতে পারি না। তবে মনে হয় কিছুদিন ঘ্যান ঘ্যান করে নিজে থেকেই থেমে যাবে। ময়না ভাইয়াকে কথাটা বলে। ভাইয়াও নাকি ওরকম ফোন কল পাচ্ছে। বললো, আমি খুব একটা ভয় না পেলেও সাবধানে থাকি। চায়নার বিয়ে হয়ে গেলে আমি নিশ্চিন্ত হতাম। বিয়ে তো ঠিক হয়েই আছে। গৌতম মহারাজের আগমনের জন্য দিন স্থির করতে একটু দেরি হয়ে গেল। এভাবেই দিন গড়িয়ে যায়। চায়নার বিয়ে হয়ে গেল। গৌতমের আকিকা হলো। ধুম ধামের অভাব নেই। ফোন কল কমে এসেছে। হয়তবা থেমে গেল তবে। প্রতিবারই কিছু একটা কণ্ঠ নয়। একেক বার একেক জন অথবা কণ্ঠ বিকৃত করে তাও হারুন জানতে পারে না।
আসিয়ার ভাশুর বিদেশে থাকেন। দেশে এসেছেন। সেই উপলক্ষ্যে হারুণের আম্মা অনেককে দাওয়াত করেছেন। হারুন আর ময়নার যাবার কথা কিন্তু হঠাৎ গৌতমের শরীরটা খারাপ করায় ও যেতে পারলো না। মা তো এ যজ্ঞের বাবুর্চি হবার জন্য আগেই বেয়ানের কাছে চলে গেছেন। দশটার ভেতরই হারুন চলে গেল। ময়নার মনটা খারাপ হয়ে গেল। এমনিতেই ওদের নারায়ণগঞ্জে যাওয়া হয় না। তার ওপর গৌতমটা কি বাঁধিয়ে বসলো! হতভাগা ছেলে আর অসুস্থ হবার সময় পেলো না।
বেলা সাড়ে বারোটায় হঠাৎ ফোন এলো নারায়ণগঞ্জ থেকে। বড়ভাই ফোন করেছে। হারুন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ওরা ওকে নিয়ে এক্ষুনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে আসছে। ও যেন বাসায় থাকে। আর কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ ময়না পেলো না। পাগলের মতো একবার জানালায় একবার দরজায় গিয়ে দাঁড়ায়। শেষ পর্যন্ত হারুণের অফিসে ফোন করে খবর পেলো। হারুন এ্যাকসিডেন্ট করেছে, ওকে ঢাকায় আনা হয়েছে মেডিক্যাল কলেজে। এক্ষুনি ময়নার কাছে গাড়ি যাচ্ছে। ময়না বুয়ার হাতে গৌতমকে বুঝিয়ে দিয়ে কোনও মতে শাড়ি জড়িয়ে তৈরি হতেই অতি পরিচিত গাড়ির হর্ণ তার কানে এলো। দৌড়ে গিয়ে গাড়িতে বসলো। কি হয়েছে ড্রাইভার, সাহেব? ড্রাইভার কি উত্তর দিলো বোঝা গেল না। মেডিকেল কলেজে ইমার্জেন্সীর সামনে ভাইয়া ও অফিসের লোকজন দাঁড়ানো। ময়না ওদের সঙ্গে দৌড়ে ঢুকলো। রক্তভেজা বিছানায় শুয়ে আছে হারুন। হারুন নেই। বাসার সামনে কটা লোক কি নিয়ে যেন ঝগড়া হাতাহাতি করছিল। হারুন ওদের থামাতে গিয়েছিল। ও পাড়ার ছেলে নামকরা মুক্তিযোদ্ধা সবাই ওকে মানে আর হারুনও সে ভাবে চলে। যারা কাছে ছিলেন তারা বলছেন, হঠাৎ কয়েকটা লোক ছুটে পালায়। পরে মনে হলো ঝগড়া, ফ্যাসাদ সব বানানো। এতদিনে প্রতিপক্ষের কাজ হাসিল হলো। ময়নার জ্ঞান ছিল না! ওকে বাসায় আনা হলো। মা, চায়না, ননদ, আসিয়া সবাই এসে পৌঁছেছে। তারপর কোথা দিয়ে কি হয়ে গেল ময়না জানে না। শুধু এটুকু উপলব্ধি করলো তার ভাঙা কপাল এবার ভেঙে শত টুকরো হয়ে গেল আর কখনোও জোড়া লাগবে না।