- বইয়ের নামঃ অদৃশ্য শত্রু
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১-০৫. আজকের দিনের আগরপাড়া স্টেশন নয়
অদৃশ্য শত্রু
০১.
আজকের দিনের আগরপাড়া স্টেশন নয় কিন্তু, ভুল করবেন তা হলে। বাইশ বছর আগেকার সেই ছোট আগরপাড়া স্টেশন। এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ তখন চলেছে—সারাটা পৃথিবী জুড়ে।
পৌষের হাড়-কাঁপানো শীতের এক সকাল। সকালের আলো ফুটেছে বটে তবে কুয়াশার ঘন আবছায়ায় সব ঝাপসা-ঝাপসা।
স্টেশনের অল্প দূরেই স্টেশন মাস্টারের কোয়ার্টার।
খান দুই ঘর। পাকা মেঝে। পাকা দেওয়াল, উপরের কিছু অংশ পাকা—কিছুটা অংশ রাণীগঞ্জের টালি ছাওয়া। সামনে ছোট একটু বাগানের মত-অজস্র বড় বড় গাঁদাফুল, যেন হলুদের একটা বন্যা।
পিছনেও সামান্য একটু খোলা জায়গা পাঁচিল ঘেরা। তার মধ্যে রান্নাঘর-স্নানঘর ইত্যাদি।
স্টেশন মাস্টার রসময় ঘোষাল ব্যাচিলর মানুষ—একাই কোয়ার্টারে থাকে। অনেক দিনের পুরানো চাকর নিতাই-সে-ই সব কাজকর্ম করে দেয় রসময়বাবুর। এক কথায় রান্না থেকে শুরু করে যাবতীয় প্রয়োজনীয় কাজ সব কিছু—অর্থাৎ জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ পর্যন্ত।
রসময় মানুষটা শান্তশিষ্ট ও একটু আয়েসী। বদখেয়াল বা নেশা বলতে সত্যিকারের কিছুই নেই—তবে ভদ্রলোকের একটা নেশা আছে।
যত রাজ্যের গোয়েন্দা কাহিনী সংগ্রহ করে পড়া।
রসময় যে কেবল গোয়েন্দা কাহিনী পড়েই আনন্দ পান তাই নয়—তার একটা বিচিত্র বিলাস আছে-ঐ সব গোয়েন্দা কাহিনী গোগ্রাসে গেলেন আর নিজেকে ঐ সব গোয়েন্দার চরিত্রে খাড়া করে মনে মনে সব জটিল পরিস্থিতি কল্পনা করে এবং সেই সব পরিস্থিতির জট মনে মনেই খোলে। মনে মনে বিচিত্র সব রহস্য গড়ে তুলে সেই সব রহস্য একটু একটু করে ভেদ করে।
মধ্যে মধ্যে নিতাইকে বলে, বুঝলি নিতাই এই মাস্টারী করা আমার কর্ম নয়।
নিতাই বোকা সরল মানুষ। প্রশ্ন করে, কেন কত্তা?
কেন কি রে—তুই কি মনে করিস এই স্টেশনমাস্টারী করে সারাটা জীবন কাটাব?
কাটাবেন না!
না—আমি তলে তলে চেষ্টা করছি।
কি চেষ্টা করছেন কত্তা?
পুলিসের গোয়েন্দা বিভাগে চাকরি যদি একটা পেয়ে যাই, বুঝলি না—ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের চাকরি। পেয়ে যেতাম চাকরি একটা, বুঝলি! কিন্তু ঐ বয়সটাই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে–
বয়েসটা আবার বাধা কি কত্তা—
পঁয়ত্রিশ বছর বয়স হয়ে গিয়েছে যে—এ বয়েসে কি আর চাকরি জোটে!
রসময় ঘোষাল মানুষটি যেমন সাদাসিধে-চেহারাটাও তেমনি সাদাসিধে। গোলগাল নাদুস-নুদুস গড়ন-গোবর গণেশ প্যাটার্নের। মাথায় সামনের দিকে চুল পাতলা হয়ে গিয়ে টাক দেখা দিয়েছে। গোলালো মুখ।
ভোঁতা নাক। ছোট ছোট চোখ—সরল চাউনি।
একটা নতুন গোয়েন্দা কাহিনী হাতে পড়েছিল গত সন্ধ্যায়।
বইটা স্টেশনের পয়েন্টসম্যান রামধনিয়া এনে দিয়েছিল। ওয়েটিং রুমে টেবিলের উপর পড়েছিল। সে পেয়েছে। বোধ হয় কোন যাত্রী পড়তে পড়তে কখন ফেলে চলে গিয়েছে।
বইটার নামটি ভারি লোভনীয় মনে হয়েছিল রসময়ের বইটা হাতে পেয়েই।
বিষের কাঁটা। বেশ মোটা বইটা।
বইটা হাতে পেয়ে রসময়ের গতরাত্রে আর ঘুম হয়নি। আহারাদি কোনমতে শেষ করে বইটা হাতে লেপের তলায় গিয়ে ঢুকেছিল—একেবারে শেষ করে তবে নিশ্চিন্ত।
শেষ যখন হল রাতের অন্ধকার তখন ফিকে হয়ে গিয়েছে।
আড়মোড়া ভেঙে উঠে পড়ে নিতাইকে চা করতে আদেশ দেয় রসময়।
মুখ ধুয়ে চা পান করে সোজা চলে আসে স্টেশনে।
ভোর হয়েছে বটে তবে শীতের কুয়াশায় চারিদিক তখনও ঝাপসা-ঝাপসা।
স্টেশনে ঘরে ঢুকতেই রসময়ের নজরে পড়ল ছোটবাবু অর্থাৎ জীবন সমাদ্দার গত দিনের টিকিটগুলো বান্ডিল করে বাঁধছে।
রসময়কে ঘরে ঢুকতে দেখে জীবনবাবু বলে, গুড মর্নিং স্যার—
গুড মর্নিং।
ঢাকা মেল আজ লেট স্যার।
কত?
তা ঘণ্টাখানেক তো হবেই।
টেলিগ্রাফের টক টক একঘেয়ে শব্দ শোনা যায়।
ফার্স্ট নৈহাটি লোকাল পাস করেনি?
হ্যাঁ—এই গেল ছেড়ে, মিনিট দশেক হবে।
টেলিফোনটা বেজে উঠল।
জীবনবাবু ফোনটা তুলে নিল।
আগরপাড়া স্টেশন—ঢাকা মেল ছেড়েছে–ঠিক আছে।
ফোনের রিসিভারটা ঝুলিয়ে রেখে জীবনবাবু চেঁচায়—ওরে ও শুকলাল—সিগন্যাল দে বাবা–ঢাকা মেল—
জীবনবাবু ঢাকা মেল পাস করার জন্য বের হয়ে গেল।
আবার টেলিফোন–
রসময় ফোনটা ধরে, হ্যালো—এস এম আগারপাড়া—কি বললেন, দমদমের আগে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে—ঢাকা মেল লাইন ক্লিয়ার পাবে না…হা-হা ঠিক আছে এখানেই দাঁড় করাচ্ছি।
রসময় ঘর থেকে বের হয়ে হাঁক দেয়, রামধনিয়া–ওরে রামধনিয়া, শুকলালকে। সিগন্যাল দিতে বারণ কর—
বিরাট লৌহদানব স্টেশনের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে গেল।
মেলের গার্ড নেমে এলেন।
কি ব্যাপার, সিগন্যাল দিলেন না কেন—একে তো এক ঘণ্টা প্রায় লেট—
দমদমের আগে একটা ছোট অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, রসময় বললে।
যত সব ঝামেলা—
গার্ড অদূরবর্তী টি-স্টলের দিকে এগিয়ে গেলেন।
রসময় ঘরে ঢুকতে যাবে—মেলের পরিচিত ড্রাইভার আব্দুল এসে সামনে দাঁড়াল।
আব্দুল মিঞা যে, কি খবর?
আব্দুল সে কথার জবাব না দিয়ে বলে, করতা-ডিসট্যান্ট সিগল্যালের কাছে কি উগগা পড়ি আছে দেইলাম–
কি আবার পড়ে আছে? রসময় শুধায়।
মানুষ মত লরে—একবার চাই আস্তক—
কাটা পড়েছে নাকি?