- বইয়ের নামঃ যাবতীয় ভালোবাসাবাসি
- লেখকের নামঃ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
এই অবেলায়
ওই যে গোলাপ দুলছে, ও কি
ফুল না আগুন, ঠিক বুঝি না।
এগিয়ে গিয়ে পিছিয়ে আসি,
ভাবতে থাকি ধরব কি না।
ভাবতে থাকি, ঠিক কতবার
ফুলের বনে ভুল দেখেছি।
ভরদুপুরে গোলাপ ভেবে
অগ্নিশিখায় হাত রেখেছি।
গোলাপ, তুমি গোলাপ তো ঠিক?
হও যদি সেই আগুন, তবে
এই অবেলায় ফুলের খেলায়
ফের যে আমায় পুড়তে হবে।
নদী কিছু চায়
নদী গ্রাস করে নিচ্ছে সাজানো-গোছানো ঘরবাড়ি।
নিকোনো উঠোন থেকে ঠাকুরদালানে,
ঘরে, বারান্দায়, সবখানে
এখন দিনে ও রাত্রে শুনে যাই তারই
তরঙ্গের ছলোচ্ছল শব্দ। আমি ঘুমের ভিতরে
ডুবে গিয়ে যে-শব্দ শুনেছি চিরকাল,
বিনিদ্র প্রহরে আজ উথালপাথাল
সেই শব্দ চতুর্দিকে ঘোরে।
নদী কিছু চেয়েছিল, চেয়েও পায়নি, তাই তার
জল উঠে এসেছিল সীমানা ছাড়িয়ে।
সবকিছু ভেঙেচুরে পেটের ভিতরে টেনে নিয়ে
সে তাই আবার
ফিরে গেছে নিজের নির্দিষ্ট সীমানায়।
শুধুই দেয় না নদী, কিছু চায়, চিরকাল চায়।
মনে পড়ে
ভুলে গেলে ভাল হত, তবু ভোলা গেল না এখনও।
পঁয়ত্রিশ বছর পার হয়ে গেছে, তবু কোনো-কোনো
মুহূর্তে তোমাকে মনে পড়ে।
স্রোতের গোপন টানে ভেসে যায় পিতলের ঘড়া।
অথচ বেদনা তার থেকে যায়। তাই বসুন্ধরা
কেঁপে ওঠে ফাল্গুনের ঝড়ে।
মনে পড়ে, মনে পড়ে, এখনও তোমাকে মনে পড়ে।
যাবতীয় ভালবাসাবাসি
এক-একবার মনে হয় যে
এই জীবনের যাবতীয় ভ্রমণ বোধহয়
ফুরিয়ে এসেছে। কিন্তু
ঠিক তখনই
আমার চোখের সামনে হঠাৎ খুলে যায়
সেই রাস্তা,
যার ধুলো উড়িয়ে আমি কখনও হাঁটিনি।
এক-একবার মনে হয় যে,
যাবতীয় ভালবাসাবাসির ঝামেলা বোধহয়
মিটিয়ে ফেলতে পেরেছি। কিন্তু
ঠিক তখনই আবার
হৃৎপিণ্ড মুচড়ে দিয়ে হঠাৎ
জেগে ওঠে অভিমান।
যাদের চিনি না, তাদের কথা আমি
কী করে বলব? কিন্তু
যাদের চিনেছিলুম, তাদের কথাও যে
বলতে পারিনি,
মধ্যরাতে এই কথাটা ভাবতে-ভাবতে আমি
বিছানা ছেড়ে
বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই।
আমি দেখতে পাই যে,
আধডোবা জাহাজের মতো এই শহরটা
ঘুমের মধ্যে
তলিয়ে যাচ্ছে, আর
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঝুপ্সি যত গাছ। অথচ
ঠিক তখনই
আকাশ জুড়ে ঝড় বইছে, আর
হাওয়ার ঝাপটে কেঁপে উঠছে লক্ষ-লক্ষ তারা।
কলকাতার এক রাজপথে
যাকে একদিন দেখতে পেয়েছিলুম,
ভাদ্রমাসের আকাশ জুড়ে
উলঙ্গ সেই দৈবশিশুর মুখচ্ছবি তখন আমার
চোখের সামনে ভাসতে থাকে।
সংসার
সংসার ছড়িয়ে গেছে ইস্টিশানে, পথে ও ফুটপাতে,
আমরা আসতে-যেতে দেখতে পাই।
আকাশে গোধূলি-লগ্নে বর্ণের সানাই
বেজে যায়।
মাঝে-মাঝে মধ্যরাতে
জানালায় মুখ রেখে ভাবি যে, ভাষায়
ফোটাতে পারিনি কোনো-কিছু।
এবং দেখি যে, কাঁথাকানিতে নিজেকে ঢেকে নিয়ে
সংসার চলেছে তার চৌহদ্দি ছাড়িয়ে।
মানুষ চলেছে পিছু-পিছু।