- বইয়ের নামঃ সত্য সেলুকাস
- লেখকের নামঃ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
থাকা মানে
থাকা মানে কিছু বই, থাকা মানে লেখার টেবিল,
থাকা মানে আকাশের নীল,
পুকুর পড়েছে রোদ, গাছের সবুজ
ছাতের কার্নিসে দুটি পাখি,
জলের ভিতর কিছু চোরা টান, সায়ংকালীন
স্তব্ধতার মধ্যে ধীরে-ধীরে
একা-নৌকাটির ক্রমে দৃষ্টির আড়ালে চলে যাওয়া।
ভাদ্রের গুমট ভেঙে বৃষ্টির খবর নিয়ে ছুটে আসে হাওয়া,
যা এসে বুকের মধ্যে লাগে।
থাকা মানে মানুষের মুখ, ঘাম, ক্লান্তি ও বিষাদ,
যা নিয়ে সংসার, তার সবই।
থাকে মানে দুঃখ-সুখে, সংরাগে-বিরাগে
সবকিছুকে হাতের মুঠোয় ধরে রাখা।
থাকা মানে আলোতে-কালোতে আঁকা ছবি,
যে-ছবি তাৎপর্যে ভরা, অথচ সম্পূর্ণ অর্থহীন।
থাকা মানে তারই মধ্যে বেঁচেবর্তে থাকা।
ভোরের ভিমরুল
রাগী ভিমরুলের মতো কয়েকটি বালক ওই দৌড়ে চলে যায়।
কাল সারা রাত খুব বৃষ্টি হয়েছিল।
এখন আকাশে মেঘমুক্ত, তার কোত্থাও দেখি না
কোনো কলঙ্কের দাগ, চিল
অনেকটা উঁচুর নীলে ফিরে গিয়ে ডানা ছড়িয়েছে।
এমন সুন্দর ভোর শ্রাবণে ও ভাদ্রে মাঝে-মাঝে
অলীক দৃশ্যের মতো দেখা দেয়।
দেখা দিলে আবার নতুন করে নিজস্ব নিয়মে
বাঁচতে সাধ জাগে।
সকলে ডেকে-ডেকে বলতে ইচ্ছা করে:
ভাল থাকো।
আদিত্যবর্ণের ছোঁয়া লাগুক সমস্ত বাসনায়।
তবু তারই মধ্যে ছন্দ-পতনের মতো
রাগী ভিমরুলের ঝাঁক দৌড়ে চলে যায়।
এত যে বয়স হল, তবু আজও এমন যাওয়ার
তাৎপর্য বুঝি না।
বুঝতে গিয়ে চোখ ফিরিয়ে ভিতরে তাকাই।
দেখি যে, সেখানে আজও মেঘমুক্ত আকাশের মতো
আরও একটা সকাল হয়েছে।
সত্য সেলুকাস
মন্দির না মসজিদ না বিতর্কিত কাঠামো, এই
ধুন্ধুমার তর্কের ভিতর থেকে
কানা-উঁচু পিতলের থালা বাজাতে-বাজাতে
বেরিয়ে এল
পেটে-পিঠে এক হয়ে যাওয়া, হাড়-জিরজিরে দুটি
নেংটি-পরা মানুষ।
তাদের পাথার উপরে দাউদাউ করে জ্বলছে মধ্যদিনের সূর্য।
তবে পরপর কয়েকটা দিন যেহেতু বৃষ্টি হয়েছে, তাই
তাদের ফুটিফাটা পায়ের তলায়
আর্যাবর্তের ঘাস এখনও হল্দে হয়ে যায়নি।
ভিড়ের মধ্যেই ছিল বটে, আর মাঝেমধ্যে তালিও বটে
বাজিয়েছিল, তবে
ধোপদুরস্ত জামাকাপড় পরা লোকগুলোর এই
তর্কটা যে ঠিক কী নিয়ে,
তার বিন্দুবিসর্গও তারা জানে না।
সভাস্থলের একটু দূরে
ঝাঁকড়ামাথা একটা তেঁতুলগাছের তলায় বসে
পিতলের থালায় এক চিমটি নুন ছিটিয়ে
ছাতু ঠাসতে-ঠাসতে
তবুও যে তারা হাসছে, তার কারণ, তাদের
একজনের নাম হতেই পারত সিকান্দর শাহ্ আর
অন্যজনের সেলুকাস
ভিড়ের ভিতর থেকে
পিতলের থালা বাজাতে-বাজাতে বেরিয়ে এসেছে দুই
লেংটি-পরা ঐতিহাসিক পুরুষ।
তাদের মাথায় উপরে জ্বলছে অনাদি ভারতবর্ষের আকাশ, আর
ইতিমধ্যে কয়েকটা দিন যেহেতু বৃষ্টি হয়েছে, তাই তাদের
ফুটিফাটা পায়ের তলায়
আর্যাবর্তের ঘাস এখনও হল্দে হয়ে যায়নি।