ঠিক সময় মতো লায়েক খান ফিরে এলো এবং তদ্বির করেই তার পোস্টিং যোগাড় করলো। থাকতে হবে করাচীতে। লায়েকের কোনও চিন্তা নেই ওখানেও ওর অনেক পেশোয়ারী দোস্ত আছে। দেখলাম ও বেশ বন্ধুবৎসল। লাল খানের বউকে একটা রূপার হার উপহার দিলো, অবশ্য বন্ধুর হাত দিয়ে। এরা পরস্পরকে ভাইবোনের মতো দেখে, দরজার আড়ালে থেকে কথাও বলে তবে সামনে আসে না। গলাগলি করে হেসে কেঁদে বিদায় নিলাম।
অতঃপর এলাম করাচীতে। লায়েক খান দেশ থেকে বেশ খোশ মেজাজেই ফিরে এসেছে। বউয়ের কথা অবশ্য আমাকে কিছু বলে নি, কারণ জানে আমার শুনতে ভালো লাগবে না। ওর দুই ছেলে বড় জনের বয়স ১৭ বছর। আর তার পরের ছেলের বয়স ১৪ বছর। মেয়ে সবচেয়ে ছোট। তার নাম ফাতিমা। এই মেয়ের গল্পই সে সব চেয়ে বেশি করে। আমিও জিজ্ঞেস করি, সেও উত্তর দিয়ে খুশি হয় এবং তার কথাবার্তায় বুঝলাম আমার কথা বিবিজান এখনও জানেন না, জানাবার মতো সাহস এবৃদ্ধের নেই। মাঝে মাঝে আমারও ভয় হয়, কে জানে জানতে পারলে আমার গলা কাটবে কিনা, তবে ভরসা বিবিজান গাঁয়ের বাইরে আসেন না। শেষ পর্যন্ত ছেলে হলো আমার। দিব্যি স্বাস্থ্যবান আর বাপের মতোই সুপুরুষ। মেয়ে হয় নি বলে খোদার কাছে শুকরিয়া জানালাম। যাক দুর্দিন এলে ছেলেকে বুকে নিয়ে গাছতলাতেও পড়ে থাকতে পারবো।
ধীরে ধীরে আশে পাশের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ হলো। লায়েক খানকে সামরিক বাহিনী থেকে পেনসন দেওয়া হলো। ও করাচীতে একজন সামরিক অফিসারের বাড়িতে নাইট গার্ডের চাকুরি নিলো। বড়বাড়ি। আউট হাউজের এক পাশে ছোট একটা ঘর, পাকের ঘর, গোসলখানা তাদের জন্য বরাদ্দ হলো। বাড়িতে আরও নোকর নোকরানী আছে, তাদের সব থাকবার ব্যবস্থা স্বতন্ত্র। স্বামীর কাছে জানতে পারলাম বাড়ির মালকীন বাংলাদেশের মেয়ে। লায়েক খানের কাছ থেকে সব শুনে তিনি আমাকে দেখতে চেয়েছেন। একদিন সাহস সঞ্চয় করে স্বামীর সঙ্গে গেলাম তাঁকে সালাম জানাতে। স্বামী বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো, আমি ভেতরে ঢুকলাম। সুন্দর অমায়িক ব্যবহারে সালমা বেগম আমাকে অতি সহজেই আপন করে নিলেন। বাড়িঘরের কথা, বাবা-মার কথা সব জিজ্ঞেস করলেন। ওদের চিঠি লিখতে বললেন তার ঠিকানায়। কতো কথা যে তার অন্তরে জমেছিল তাই ভাবি। শেষ পর্যন্ত আমি ওঁর ঘরে কাজ নিলাম। আমি ওঁর কাজ করবো। ওদের সন্তানাদি নেই। জামা-কাপড় ধোয়া, ইব্রিরি করা, বিছানা করা, ঘর গোছানো, পার্টি হলে তার ব্যবস্থা করা এমন কি মাঝে মাঝে বাংলাদেশের মতো মাছ-তরকারিও আমি তাকে রান্না করে দিতাম। ওঁর কাছে বাংলা বইও ছিল অনেক। সেগুলোও মাঝে মাঝে চেয়ে নিতাম। আমার জীবনে এক নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে গেল।
সালমা বেগমের উৎসাহে ও সাহসে দেশে আব্বাকে চিঠি লিখলাম সব কিছু জানিয়ে এবং তাঁদের খবরা খবরও জানতে চাইলাম। ঠিকানা সালমা বেগমের। এক মাসের ভেতর বাবার চিঠির উত্তর পেলাম। তারা ভালো আছেন। নাতিকে দোয়া জানিয়েছেন। দেখতে না পারার জন্য দুঃখ করেছেন। ব্যবসা বড়ভাই ও সালু চালাচ্ছে। আব্বা আর দোকানে যান না। যা জমি-জিরাত আছে তাই তদারকি করেন। মিলু এবার ম্যাট্রিক দেবে। এ বছর বড়ভাই বিয়ে করেছেন। তখন আমার ঠিকানা জানলে আমাকে নিশ্চয়ই দাওয়াত পাঠাতেন। তার শরীর ভালো না। তিনি আম্মার কাছে যাবার প্রতীক্ষায় আছেন। সমস্ত চিঠিতে কেমন যেন একটা ক্লান্তি ও শুনতার সুর। আমি থাকলে বাবাকে মায়ের জন্য এতো কাতর হতে দিতাম না। কিন্তু কি আশ্চর্য বাবা আমাকে একবারের জন্যও যেতে লেখেন নি। ভালো লাগলো দেশের লোকেরা এখনও পাকিস্তানিদের জঘন্য অত্যাচারের কথা মনে রেখেছে ভেবে। আজ অবস্থার প্রেক্ষিতে আমি বৃদ্ধ অশিক্ষিত লায়েক খানের গৃহিনী কিন্তু যদি সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশে থাকতাম তাহলে সম্ভবত একটা ভদ্র পরিবারে থাকতে পেতাম। না হয় অর্থ-সম্পদ নাই পেতাম। তারপর সমুদ্রে ডুবে যাই আমি। তবুও এই বাঙালি মহিলাকে পেয়ে আমি যেনো নতুন আলো পেয়েছি জীবনের।
আমি আবদার ধরলাম ছেলের নামকরণ করবো আমি। স্বামী রাজি হলেন। আকিকায় ছেলের নাম রাখা হলো তাজ খান। সবাই খুশি সুন্দর নাম আর আমি মনে মনে স্মরণ করলাম এক পরম সাহসী মহান বাঙালি বীর যোদ্ধাকে। যিনি যুদ্ধজয় করেও, জয়ের গৌরব থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। কে জানে বিধির বিধান বুঝতে পারি না।
দিন দ্রুত কেটে যাচ্ছে। এর ভেতর আমি সেলাই শেখার কেন্দ্র থেকে নানা রকম সুচিশিল্প শিখে ফেলেছি। ঘরে বসেই কাজ করি, বেশ ভালো আয় হয়। সালমা বেগম আমাকে তার পরিচিত মহলে কাজ করবার সুযোগ করে দিলেন। লায়েক খান মনে হয় খুশিই হলো কিন্তু কোনও দিন আমার কাছ থেকে একটি পয়সাও নেয় নি। দিতে গেলে বলেছে তোমার খাওয়া পরার দায়িত্ব আমার। আমি তোমাকে কিছুই দিতে পারি নি। এখন তো ঘাড়ের উপর দু’সংসার। মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে তোমার জীবনটা আমি বরবাদ করে দিয়েছি। আমি ওর মুখ চেপে ধরতাম, বলতাম তুমি আমাকে উদ্ধার না করলে আমি ভেসে যেতাম। তোমার জন্য আমি স্বামী পেয়েছি, সংসার পেয়েছি, তাজের মতো বুক জুড়ানো সন্তান পেয়েছি। সালমা বেগমের জন্য আমি অর্থ পেয়েছি বাইরে ইজ্জত পেয়েছি। একটা মেয়ে আর কি চায়। তবুও আমার স্বামী একটা কথাই বলতো, তোকে নিয়ে আমি ঘর বসাতে পারলাম না অর্থাৎ নিজের দেশে নিজের সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলো না। আমি ভাবতাম এ আমার শাপে বর হয়েছে। ঘর বসালে তোমার জীবনে ক্ষেতির কাজ আর গম পিষতে পিষতে আমার জীবনটা শেষ হয়ে যেতো। এ তো ভালোই আছি একরকম। তাজের বয়স যখন পাঁচ, স্বামী আবদার জুড়ালো ওকে একবার দেশে নিয়ে যাবেন। সালমা বেগমের পরামর্শ চাইলাম, উনি বললেন যেতে দে, কি আর হবে? ছেলেই তো, মেয়ে হলে ভয়ের কথা ছিল। দু’সপ্তাহের জন্য তাজ বাপের হাত ধরে মাথায় জরির টুপি পরে সেজে গুঁজে চলে গেল তার নিজের ঠিকানায়। মনকে সান্ত্বনা দিলাম আজ না হলেও দশ বছর পরে তো লায়েক চলে যাবে। তখন তাজ তো, সগর্বে বলবে আমি আগে পাঠান পরে পাকিস্তানি। যেমন একদিন আমরাও সগর্বে বলেছিলাম, আমরা আগে বাঙালি পরে মুসলমান, পাকিস্তানি আর সব। মনে হলো লায়েক খানের আমানত যা আমি গর্ভে ধারণ করেছিলাম, এ পাঁচ বছর প্রতি মুহূর্তের স্নেহ দিয়ে বড় করেছি তাকে আজ তার হাতেই ফিরিয়ে দিলাম। কেমন যেন সব কিছুই আমার কাছে শূন্য হয়ে গেল।