তার মানে ওরা এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে? কামাল জিজ্ঞেস করলো।
হ্যাঁ। ওরা সবাই যুদ্ধ-সাজে সেজে রওনা দিয়েছে। এখানে পৌঁছতে ওদের পনেরো মিনিটের বেশি লাগবে না।
দেড় ঘন্টার পথ পনেরো মিনিটে আসবে কি করে?
দেড় ঘন্টার পথ আমাদের কাছে। ইসলাম খাঁ হাসলেন। ওদের কাছে এটা পনেরো মিনিটের পথ! ওরা ঘন্টায় দশ-পনেরো মাইল চলতে পারে গভীর বনের মধ্যে দিয়েও।
তার মানে আর পনেরো মিনিটের মধ্যে আমরা ধরা পড়ছি? আমাদের আর গুলিও তো নেই বেশি। ঠেকাবো কি করে ওদের? কামাল হতাশ হয়ে পড়ে।
সবাই জোরে পা চালাও। শহীদ হুকুম দেয়।
প্রায় দৌড়ের মতো করে চলেছে ওরা। বাঁচতেই হবে তাদের। কোনও মতে লঞ্চে পৌঁছতে পারলে হয়। সমস্ত শক্তি একত্র করে সবাই প্রাণপণ ছুটছে। কিন্তু সমান গতিতে চলা যাচ্ছে না! পথের মাঝে প্রায়ই মােটা ডাল কিংবা আস্ত গাছ কালকের ঝড়ে ভেঙে পড়ে আছে।
থাম, থাম, আর পারি না। চিৎকার করে উঠেন ইসলাম খাঁ। ভীষণ হাঁপাচ্ছেন তিনি।
দাঁড়িয়ে পড়লো সবাই। কিন্তু বিশ্রাম করবার সময় নেই। অথচ ইসলাম খাঁ আর সহ্য কতে পারছেন না। সবাই প্রমাদ গুণলো। শেষকালে তীরে এসে তরী ডুববে?
আমাকে ফেলে রেখে তোমরা চলে যাও। আমাকে ওরা মারবে না, তোমাদের মারবে। আমার জন্যে তোমাদের সবাইকে আমি মৃত্যু বরণ করতে দেবো না। ইসলাম খাঁ নামার চেষ্টা করেন। এদিকে ঢাকের শব্দ ক্রমেই এগিয়ে আসছে। অনেক ঢাক একসাথে বাজছে। লোকজনের চিৎকার একেবারে কাছে এসে পড়েছে।
আধাে আলো আধাে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে শহীদরা আবার ছুটলো। আর অপেক্ষা করা যায় না। ঢাকের শব্দ যেভাবে এগিয়ে আসছে, আর বেশিক্ষণ লাগবে না তাদের ধরতে।
প্রাণপণে ছোটো সবাই। কেউ থামবে না। শহীদ চিৎকার করে বলে।
সবাই ছুটছে। খুব কাছে এসে পড়েছে ঢাকের শব্দ। হৈ-হল্লা আর পায়ের শব্দ শুনে বোঝা গেল, কম হলেও হাজার দুয়েক লোক হবে ওরা।
ওই তো নদীর ঘাট দেখা যায়। হ্যাঁ, এসে পড়েছে তারা। পিছনে জংলীরাও প্রায় এসে পড়েছে। ঢাকের শব্দে আর কোনও শব্দ শোনা যায় না। ইসলাম খাঁ প্রাণপণে চিৎকার করছেন, থামাে, থামো আমাকে ফেলে রেখে যাও। বড় কষ্ট পাচ্ছি…
কিন্তু কেউ তাঁর কথা শুনতে পাচ্ছে না। সমানে দৌড়ে চলেছে। কামাল সবচাইতে আগে আগে চলছে।
শহীদের মনে মনে একটা ভয় ছিলো। কালকের সাইক্লোনে যদি লঞ্চ ভেসে চলে, গিয়ে থাকে তাহলে সর্বনাশ হবে। নদীর ঘাটে পৌঁছে দেখা গেল মােটা গাছের সাথে বাঁধা লঞ্চ ঠিক তেমনিই রয়েছে।
লাফিয়ে সবাই লঞ্চে উঠলো। জংলীরা এসে পড়েছে, কিন্তু আর ভয় নেই। জলে কেউ নামতে সাহস পাবে না। কামাল গাছের সাথে বাঁধা দড়িটা খুলে লঞ্চে উঠেই স্টার্ট দিলো।
ঘাট থেকে বেশ অনেকটা দূরে লঞ্চ সরিয়ে সবাই একটা হাঁফ ছাড়লো। অদ্ভুত একটা স্বস্তি। কিন্তু একটা কথা একসাথে সবার মনে পড়লো। কুয়াশা? কুয়াশা কই?
কামাল নোঙর ফেলে দিলো। কুয়াশা না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
দি দিড়িম, দি দিড়িম ঢাক বাজছে। ওরা একেবারে কাছে এসে পড়েছে।
ঠিক এমন সময় ভীষণ বেগে নদীর ঘাটের দিকে ছুটে আসছে কে? কুয়াশা না? সেই তো! মহুয়া চিৎকার করে উঠলো, দাদা!
বিদ্যুৎগতিতে ছুটে এলো সে। পাড়ে এসেই থমকে দাঁড়ালো কুয়াশা। পিছনে চেয়ে দেখলে পঁচিশ গজ দূরেই দেখা যাচ্ছে অর্ধ-উলঙ্গ কৃষ্ণ মূর্তি। এক হাতে ঢাল আর এক হাতে তীক্ষ্ণ বর্শা নিয়ে ছুটে আসছে এই দিকে। আর চিন্তা করবারও সময় নেই। সেই অবস্থায় লঞ্চ ঘাটে আসতে পারে না।
তরতর করে একটা মস্তবড় গাছে উঠে গেল কুয়াশা। জংলীরা এসে দাঁড়িয়েছে পাড়ে। ওরা দেখলো শহীদদের ধরা অসম্ভব। কিন্তু কুয়াশাকে তারা দেখেছে। সে পালিয়ে যাবে কোথায়? মহুয়া অস্থির হয়ে উঠলো।
দু-তিনজন লোক গাছের তলায় ঢাল রেখে কেবল বর্শাটা হাতে নিয়ে গাছে উঠে আসতে লাগলো। বেশ অনেকদূর এসেছে এমন সময় গাছের ওপর থেকে গুলি করলো কুয়াশা। প্রথম জন গুলি খেয়ে চিৎকার করে গাছ থেকে পড়ে গেল। দ্বিতীয় জন একটু থমকে থেকে আবার ওঠা শুরু করলো। আবার গুলি করে কুয়াশা। সেও পড়লো, মাটিতে।
শহীদ ভাবছে ওরা বুঝি ভয় পেয়ে গাছে ওঠা বন্ধ করবে। কিন্তু না, আরও অনেক লোক গাছের নিচে ঢাল রেখে উঠে আসতে লাগলো। ক্ষেপে গেছে ওরা। কুয়াশাকে তাদের চাই-ই। ধর্ম ছাড়া আর কিছুকে ভয় পায় না ওরা।
কুয়াশা গুলি করে চলেছে। হঠাৎ রাইফেলটা ক্লিক করলো। গুলি বেরোলো না। ফুরিয়ে গেছে গুলি। পকেট হাতড়ায় সে। না, নেই আর।
রাইফেলটা ছুঁড়ে মারে সে একজনের মাথায়।
কিন্তু তারপর? এবার উপায় কি? উঠে আসছে হিংস্র জংলীরা একজনের পর একজন। রাইফেল তুলে নিলো শহীদ। একজন পড়ে গেল গাছ থেকে আর্তনাদ করে। আবার একজন। আবার একজন।
ওরা চেয়ে দেখলো শহীদ গুলি করছে। এবার ওরা লঞ্চের দিকটা গাছ দিয়ে আড়াল করে উঠতে লাগলো।
আর উপায় নেই, গুলি লাগছে না ওদের গায়ে। উঠে আসছে ওরা ক্রমেই।
কুয়াশাও উপরে উঠছে। গাছের মগডালে উঠে গেল কুয়াশা। আর বাঁচবার কোনও উপায় নেই।
ওকি? লাফিয়ে পড়বে নাকি? কুয়াশা দাঁড়িয়ে উঠে ওপরের ডালটা দোলাচ্ছে। এতদূর লাফিয়ে আসা কি সম্ভব? তবু শেষ চেষ্টা করবে কুয়াশা। খুব জোরে একটা দোলা দিয়ে শূন্যে উঠে গেল সে।