- বইয়ের নামঃ পিরামিডের গুপ্তধন ২
- লেখকের নামঃ কাজী আনোয়ার হোসেন
- সিরিজঃ কুয়াশা সিরিজ
- প্রকাশনাঃ সেবা প্রকাশনী বই
- বিভাগসমূহঃ কল্পকাহিনী, রহস্যময় গল্প, রোমাঞ্চকর গল্প
পিরামিডের গুপ্তধন ২
কুয়াশা ৪ (ভলিউম ২)
০১.
মৃদু গর্জন করে শহীদের ক্রিমসন কালারের ফোক্সওয়াগেনটা কামালের গাড়ি বারান্দায় এসে থামলো। তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলো শহীদ একতলার ড্রইংরূমের সামনে, তারপর প্রচণ্ড এক হুঙ্কার ছাড়লো, কামাল।
ঘরের ভেতর থেকে আওয়াজ এলো, ঘেউ!
অবাক হয়ে যায় শহীদ। ব্যাপার কি? কামালের ঘরে কুকুর! ও আবার কবে থেকে কুকুর পুষতে আরম্ভ করলো? দামী ভেলভেটের পর্দা একটু ফাঁক করে দেখলো একটা সোফায় বসে টেবিলের ওপর দুই পা তুলে দিয়ে চোখ বুজে সিগারেট টানছে কামাল। ঘরের মেঝেতে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত গোটা কতক সস্তা দরের ইংরেজি রহস্যোপন্যাস, মিকি স্পিলেন, লেসলি চার্টেরিস, আগাথা ক্রিষ্টী, আয়ান ফ্লেমিং, স্টেনাল গার্ডনার, কনান ডয়েল; আর বিভিন্ন ধরনের পত্র-পত্রিকা, রিডার্স ডাইজেস্ট, গানস এণ্ড গেম, আউট ডোর লাইফ, পপুলার সায়ান্স, ফিল্ড এণ্ড স্টীম, লাইফ, টাইম, নিউজ উইক–সব একসাথে মিলেমিশে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ঘরে ঢুকে এক নজর চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে শহীদ বললো, ব্যাপার কি কামাল? ঘরের এই অবস্থা কেন? তোর বাড়িতে কুকুর এলো কোত্থেকে?
ঘেউ। কামালের মুখে সেই একই উত্তর।
হেসে ফেলে শহীদ বললো, তোর আবার এই রূপান্তর ঘটলে কবে? আর কিছু হতে পারলি না, শেষ পর্যন্ত কুকুর হয়ে গেলি!
শুধু কুকুর নয়, একেবারে ক্ষ্যাপা কুকুর। ঘেউ ঘেউ ঘেউ!!
ওরে বাপরে, তবেই সেরেছে! একটু দূরেই বলি? ধপাস করে কামালের পাশে। বসে পড়লো শহীদ।
আর কতদিন, শহীদ? এভাবে শুয়ে বসে শরীরে যে ঘুণ ধরে গেল। তুই তো পণ করেছিস গোয়েন্দাগিরি করবি না–কিন্তু আমার দিন কাটে কি করে বল তো?
তুই কীরে? স্নেহের সুরে বললো শহীদ, এখনো পাগলাই রয়ে গেলি। চিরকাল কি আর ঐ চোর-পুলিস খেলা ভালো লাগে? চলে আয় আমার সাথে, নেমে পড় ব্যবসায়। এটাও একটা অ্যাডভেঞ্চার, কামাল।
কদিন ধরে দিনরাত কেবল ভাবছি। সেই যে দুমাস আগে কুয়াশা ওর গরিলাটা নিয়ে প্লেনে করে চলে গেল মিশরের পথে-তারপর মি. সিম্পসন কিছুদিন ঘুর ঘুর করেছেন আশেপাশে। ছোটোখাট এক আধটা কেসে একসাথে কাজও করেছি। কিন্তু কিছু ভাল্লাগলো না। তোকে পাশে না পেলে কোনও কাজেই আমার আনন্দ লাগে না। সেই ছোটকাল থেকে উপগ্রহের মতো কেবল তোর চারপাশে অনবরত ঘুরে মরছি– তোর মধ্যে কি যে যাদু আছে বুঝি না। তোকে ছাড়া কিছু করতে গেলে অসম্পূর্ণ লাগে সব কাজ, মনে হয় শরীরের অর্ধেকটা যে অবশ হয়ে আছে। অনেক চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত বুঝে নিয়েছি এ বাঁধন থেকে আমার মুক্তি নেই।
অন্যমনস্ক ভাবে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে চেয়ে কথাগুলো বলে যাচ্ছিলো কামাল। কেন জানি বড় করুণ শোনালো ওর কথাগুলো। শীতকালের রাত আটটাকে অনেক রাত মনে হচ্ছিলো। বাইরের প্রশস্ত রাস্তাটা হেড-লাইটের উজ্জ্বল আলোয় উদ্ভাসিত করে দিয়ে এক একটা গাড়ি চলে যাচ্ছিলো মৃদু গুঞ্জন তুলে। তারপর আবার ল্যাম্প পোস্টের হলদে মলিন আলোয় চওড়া পীচ ঢালা রাস্তাটাতে নেমে আসছিল যেন শূনা মঞ্চের রোমাঞ্চ।
হঠাৎ একটু হেসে কামাল গুনগুন করে ওর একটা প্রিয় গানের কলি ধরলো:
আটক রইয়াছি বন্ধু তোমার
পাগলা ফাটকে।
ভাবছি, তোর সাথে ব্যবসাতেই নেমে পড়বো। তুই আমাকে যাদু করেছিস, শহীদ। কেন আমাকে খোদা এমন দুর্বল আর স্পর্শকাতর করে তৈরি করেছেন বলতে পারিস?
কিন্তু কোথায় শহীদ? জবাব না পেয়ে কামাল ঘড়ি ফিরিয়ে দেখলো কখন অলক্ষ্যে বেরিয়ে গেছে সে ঘর থেকে। নিশ্চয়ই টিকিয়ার গন্ধে রান্নাঘরের দিকে ছুটেছে ব্যাটা। কামালের মায়ের হাতের টিকিয়া সেই ছেলেবেলা থেকেই অর্ধেক শহীদের জন্য রিজার্ভ করা থাকে। সোফা ছেড়ে উঠে পড়লো কামাল। এবং ঠিক সেই সময় ঘটলো ঘটনাটা। শূন্য মঞ্চে কখন যে নাটক শুরু হয়ে গিয়েছে টের পায়নি কামাল।
কামাল শুধু জানালা দিয়ে এক ঝলক দেখতে পেলো একজন লোক প্রাণপণে ছুটে আসছে এ বাড়ির দিকে, আর তার দশ গজ পেছনে ছুটছে ছুরি হাতে দুজন মুখোশধারী লোক।
এক তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার কানে এলো। বাইরের দরজার দিকে ছুটলো কামাল। কিন্তু বাড়ির ভেতর দিকের একটা দরজা দিয়ে ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকলো শহীদ।
খবরদার কামাল! বাইরে বেরোবি না। দরজার সামনে থেকে জলদি সরে যা।কথাটা বলতে বলতে একহাতের ধাক্কায় হতভম্ব কামালকে সরিয়ে দিলো শহীদ দরজার সামনে থেকে। এতক্ষণে কামাল লক্ষ্য করলো শহীদের ডানহাতে ওর প্রিয় কোন্ট-পুলিস স্পেশাল রিভলভারটা ধরা। দুর-দুর করে উঠলো কামালের বুকের ভেতরটা অজানা এক আশঙ্কায়।
দরজার বাইরে পায়ের শব্দ শোনা গেল। তারপরই হুড়মুড় করে চৌকাঠের সামনে ভারি কিছু পতনের শব্দ হলো। সেই সাথে অদ্ভুত একটা বিজাতীয় গোঙানির শব্দ।
এক ঝটকায় পর্দাটা সরিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলো শহীদ। দেখলো উপুড় হয়ে পড়ে আছে মেঝের ওপর একজন লোক। এক মাথা ঘন কালো কোঁকড়া চুল ছাড়া চেহারার আর কোনো কিছু দেখা গেল না। পিঠের ওপর আমুল বিঁধে আছে একটা ছইঞ্চি ব্লেডের ছোরা। সাদা শার্টটা লাল হয়ে উঠছে একটু একটু করে।