হঠাৎ গোলমাল থেমে গেল। বেশ কিছুক্ষণ সমস্ত মাঠটায় অখণ্ড নীবরতা থমথম করতে লাগলো। এতগুলো লোক একখানে, কিন্তু একটু শব্দ নেই। চার-পাঁচজন পরপরই একজনের হাতে একটা করে মশাল জ্বলছে। তার আলোতে থমথমে মুখগুলো ভয়ঙ্কর লাগছে দেখতে।
একটু পরেই উচু একটা পাথরের ওপর কয়েকজন লোকের সাহায্যে উঠে দাঁড়ালেন ইসলাম খাঁ। সাদা আলখাল্লা পরেছেন তিনি। বন্দীদেরও হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পাথরের ওপর এনে রাখা হলো।
এবার ইসলাম খা চিৎকার করে কি যেন বললেন। সবাই হাঁটু গেড়ে বসলো। তারপর একটা গুঞ্জন ধ্বনি শুনতে পাওয়া গেল। মনে হচ্ছে যেন অসংখ্য ভ্রমর উড়ে বেড়াচ্ছে আশপাশে। গম্ভীর মন্ত্রোচ্চারণ শুনে কেমন যেন ভয় ভয় করে। কোনো এক অদৃশ্য মহাশক্তির সামনে মাথা নত হয়ে আসে।
থেমে গেল মন্ত্রোচ্চারণ। চারদিক নিস্তব্ধ। নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো সবাই। এবারইসলাম খাঁ মন্দিরের দিকে মুখ করে দাঁড়ালেন। কয়েকজন জংলী পাথরের ওপর উঠে এসে বন্দীদের পায়ের বাঁধন খুলে দাঁড় করালো। গুরুগম্ভীর কণ্ঠে কিছুক্ষণ মন্ত্র পাঠ করলেন ইসলাম খাঁ। মন্ত্রোচ্চারণের ফাঁকে ফাঁকে নানারকম কিম্ভুতকিমাকার অঙ্গভঙ্গি করলেন তিনি। তাই দেখে মহুয়া তো হেসেই খুন।
মন্ত্রপাঠ শেষ করে বাটি থেকে কি একটা জিনিস তুলে বন্দীদের কপালে মাখিয়ে দিলেন তিনি।
হঠাৎ অত্যন্ত কাঁপা শুরু করলেন তিনি। থরথর করে সমস্ত শরীর কাঁপছে। কপালের দুধারের রগ টিপে ধরেন ইসলাম খাঁ। ভীষণ অসুস্থ মনে হচ্ছে তাঁকে। কয়েজন জংলী এগিয়ে এসে তাঁকে ধরলো।
ময়দানের সবাই অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে উঠলো দেখা যাচ্ছে। সবাই এ ওর দিকে তাকাচ্ছে। কামাল উৎকণ্ঠিত হয়ে বললো, কি হলো চাচাজানের? শরীর খারাপ নাকি?
শহীদ হাসলো। বললো, অভিনয় শুরু হয়েছে। বুড়োর রস তো কম না।
কিসের অভিনয়?
পরে শুনিস। এখন কেবল দেখে যা। কাঁপতে কাঁপতে পাথরের ওপর বসে পড়লেন ইসলাম খাঁ।
এবার মৃদু গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। সবার মুখেই এক প্রশ্ন, কি হলো?
আবার উঠে দাঁড়ালেন ইসলাম খাঁ। হাত উঁচু করে থামতে ইঙ্গিত করলেন। সবাই চুপ হয়ে গেল। কাঁপা কাঁপা গলায় তিনি ওদের কি কি সব বললেন।
ময়দানের সব লোককে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে উঠতে দেখা গেল। ওরা নিজেদের মধ্যে কি কি বলাবলি করতে লাগলো। ক্রমে ভীষণ কলরব। কারও কথা কেউ শুনতে পায় না, সবাই কথা বলতে চায়।
আবার হাত ওঠান ইসলাম খাঁ। সবাই থেমে যায়। আবার কিছুক্ষণ কথা বলেন তিনি। এবার জন-পনেরো লোক এগিয়ে আসে তাঁর দিকে। বোধহয় এরাই মােড়ল এখানকার। কিছুক্ষণ তারা নিজেদের মধ্যে কথা বললো, তারপর ইসলাম খাঁকে কি যেন বললো। তিনি হাত নেড়ে ওদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে চলে এলেন বন্দীদের কাছে। তিনি তাদের সামনে হাঁটু গেড়ে বোধকরি ক্ষমা প্রার্থনা করলেন জোরে জোরে। সকালের মৃতদেহ দুটোও পাথরের ওপর নিয়ে আসা হলো। তিন-চারজন জংলী জল নিয়ে এলো কুঁজো করে। তারপর মৃতদেহ দুটোকে স্নান করালো সেই পাথরের ওপরই উলঙ্গ করে। তাদের কপালেওঁ সেই বাটি থেকে কি যেন নিয়ে মাখিয়ে দিলেন ইসলাম খাঁ।
তারপরই শুরু হলো ঢাক আর হট্টগোল। ওরা এগিয়ে আসছে। পাথর থেকে নেমে ইসলাম খাঁ খালের দিকে চলতে লাগলেন খুব ধীরে ধীরে। ছজন জোয়ান লোক বন্দী চারজন আর লাশ দুটোকে কাঁধে তুলে নিয়ে তার পিছন পিছন চলছে। আর বাকি সবাই কিছুটা দূরত্ব রেখে পিছন পিছন ভীষণ হৈ-হল্লা করতে করতে আসছে। কাছে এসে পড়েছে ওরা। খাল থেকে হাত পঞ্চাশেক দূরে এসে পিছনের জনতা থেমে গেছে। জংলীরা সব পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
বুকের ভিতরটা টিপ টিপ করছে মহুয়ার। এখনি একটা সাংঘাতিক ঘটনা ঘটবে। ফলাফল কি হবে তা এখনও অনিশ্চিত। হয়তো ওরা জংলীদের হাতে ধরা পড়বে। হয়তো বা পালিয়ে যেতে পারবে। চোখের সামনে দেখছে সে, শহীদের বাবা এগিয়ে আসছেন। চারদিকে সব চুপ। এই নিস্তব্ধতা সময়টাকে আরও ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। বড়ো আস্ত হাঁটছেন শহীদের বাবা। সময় যেন এগোতেই চাইছে না। শিরদাঁড়ার মধ্যে দিয়ে শিরশির করে ঠাণ্ডা একটা কিসের স্রোত অনুভব করে মহুয়া।
সবাই প্রস্তুত? শহীদ প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ। প্রস্তুত। স্থির দৃষ্টিতে সামনে চেয়ে থাকে কুয়াশা।
সকলেই উত্তেজনায় অল্প অল্প কাঁপছে। কামাল আর গফুরের কপাল ঘামতে শুরু করলো। শুধু পাথরের মতো নিল দাঁড়িয়ে আছে কুয়াশা আর শহীদ। অদ্ভুত এদের স্নায়ুর শক্তি। কোনো চাঞ্চল্য নেই।
আমি, কুয়াশা আর কামাল গুলি করবো। গফুর, তুই হাতবোমা নিয়ে তৈরি থাক। আমাদের গুলির পরই ছুঁড়বি।
এগিয়ে আসছেন ইসলাম খাঁ। সাঁকোটার ওপর গিয়ে জলে ফেলে দেয়া হবে মৃতদেহ আর বন্দীদের। সবাই চুপ করে অপেক্ষা করছে তার জন্যে।
ইসলাম খাঁ অর্ধেক পথ এসেছেন, অমনি তিনটা রাইফেল একসাথে গর্জন করে উঠলো। তিনজন বাহক তৎক্ষণাৎ পড়ে গেল মাটিতে। আবার গর্জন করে উঠলো। রাইফেল। বাকি তিনজনও। শহীদের বাবা বসে পড়লেন বন্দীদের বাঁধন খুলবার জন্যে ।
এদিকে জংলীরা ভড়কে গেল। সত্যিই কি তাহলে মহাপ্রলয় শুরু হলো? এমন তো আর কখনো হয়নি।
এমন সময় প্রচণ্ড শব্দে তাদের সামনের কয়েকজনের ওপর হাতবোমা পড়লো। সামনের লোকগুলো আর্তনাদ করে পড়ে গেল মাটিতে। কেউ কেউ আহত না হয়েও ভয়েই চিৎকার করছে আর মাটিতে পড়ে হাত-পা ছুঁড়ছে।