আর আধমাইল খানেক গেলেই ওরা দেখতে পাবে জংলীদের আস্তানা। কিন্তু অন্ধকার বড় দ্রুত ঘনিয়ে আসছে। জঙ্গলও গভীর থেকে গভীরতর হয়ে উঠছে। গফুর বললো, আঁধার হয়ে গেল যে! ফিরে চলো দাদামণি, কাল ভােরের বেলা আবার আসা যাবে।
আরে চল, বেশি দূর নেই। এতদূর এসে আর ফিরবো না। দেখেই যাই।
পথটা ধরে আরও অনেকদূর গিয়ে দেখা গেল একটা প্রাচীর। মোটা মােটা গাছ পাশাপাশি এমনভাবে বেড়ে উঠেছে যে তা ভেদ করে ওপাশে যাওয়া যায় না। পথটা দুভাগ হয়ে দুদিকে চলে গেছে। শহীদ বুঝলো ডান ধারের পথ ধরে খালটার কাছাকাছি যাওয়া যাবে। চার্ট খুলে দেখলো মন্দিরটা খালের কাছাকাছিই এক জায়গায়। সেই পথেই এগোলো তারা।
কিন্তু এই পথ হলো কি করে? এখান দিয়ে মানুষের যাতায়াত আছে নিশ্চয়ই। বন্য জানোয়ারের তৈরি পথও হতে পারে। শহীদ এতক্ষণ একথা ভাবেইনি। সচকিত হয়ে যতদূর দৃষ্টি যায়, দেখে নিলো সে ভালো করে।
সেই পথ ধরে অনেকদূর চলে গেল তারা। কিন্তু বনের মধ্যেটা ভীষণ অন্ধকার হয়ে এলো। সামনে আর কিছুই দেখা যায় না। এই অন্ধকারে পথ চলা অত্যন্ত বিপজ্জনক। টর্চও বেশিক্ষণ জ্বালাতে ভরসা পাচ্ছে না শহীদ।
কামাল বললো, কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। শহীদ এই অন্ধকার আর ফেরা ঠিক হবে না।
তাই ভাবছি। আর এগোনো ঠিক না। সামনের বড় গাছটায় উঠে পড়বো।
আমি তো গাছে চড়তে জানি না। মহুয়া কাতর হয়ে বললো।
তাহলে নিচেই থাকতে হবে তোমাকে। কি আর করা। আমরা গাছে চড়ে বসে তোমাকে পাহারা দেবো।
নইলে ফিরে চলো লঞ্চে।
আর তো ফেরা সম্ভব না।
মহুয়া কি একটা বলতে যাচ্ছিলো, এমন সময় বনের মধ্যে খচমচ করে শব্দ হলো। সবাই চমকে উঠে সেদিকে রাইফেল তুললো। শহীদ টর্চ জ্বেলে ধরলো। দুতিনটা শিয়াল। রাস্তার ওপর কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে ওদের দিকে চেয়ে রইলো, তারপর একছুটে ডানপাশের ঘন জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়লো।
বড় ডর লাগিয়ে দিয়েছিল। গফুর বললো।
নে, আর ডর পেতে হবে না, এই গাছটায় উঠে পড় চটপট।
গফুর একটা মস্ত বড় গাছে তরতর করে উঠে গেল রশি হাতে নিয়ে। নিচে টর্চ জ্বেলে ধরে রইলো শহীদ। একটা মােটা ডালে শক্ত করে রশিটা বেঁধে আরেক মাথা নিচে ঝুলিয়ে দিতেই কামাল সেটা বেয়ে ওপরে উঠে গেল। এবার শহীদ মহুয়াকে বললো, তুমি আমার পিঠে চড়ে শক্ত করে গলা ধরে থাকো। উঃ! অত জোরে না, ব্যথা পাই। হাঁ, এই রকম করে ধরে থাকবে, ঢিল দিও না, খবরদার।
দক্ষ জিমনাস্ট শহীদ মহুয়াকে অনায়াসে পিঠে নিয়ে উঠে এলো গাছের উঁচু ডালে। বেশ মােটা ডাল। কারও যদি অফিসের দারোয়ানের মতো বেঞ্চিতে ঘুমানোর অভ্যেস থাকে তো অনায়াসে ডালের ওপর ঘুমিয়ে রাত কাটিয়ে দিতে পারে। কিন্তু শহীদদের কারো চোখে ঘুম নেই। অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো তারা। সবাই বুঝতে পারছে, এভাবে ঝোঁকের মাথায় বেরিয়ে পড়া ঠিক হয়নি। কতো রকম বিপদ, কত অসুবিধা। সাথে তারা মনে করে খাবার আনেনি। কেবল কাঁধে করে জল এনেছে সবাই এক এক বোতল।
কত রকম সাপ থাকতে পারে গাছে। দয়া করে একটা কামড় দিলেই ব্যাস খতম। কয়েকটা বানর ওদের আস্তানা বেহাত হয়ে গেল দেখে খ্যাচম্যাচ করে আপত্তি জানাচ্ছিলো এতক্ষণ। এবার তারা পাশের একটা গাছে গিয়ে নীরবে এইসব অপরিচিত অসভ্য আগন্তুকের উপর লক্ষ্য রাখছে।
কানের পাশ দিয়ে একেকবার পিন করে মশা ঘুরে যাচ্ছে। বোধকরি ভাবছে, ব্যাটারা, ঘুমিয়ে নাও তারপর দেখা যাবে।
হঠাৎ দূর থেকে একটা বিকট আওয়াজ শোনা গেল। মহুয়ার বুকের ভেতরটা যেন কেঁপে উঠলো। শহীদের হাতটা ধরে ফেলে জিজ্ঞেস করলো, কিসের আওয়াজ?
সিংহ ডাকছে।
খুব কাছেই মনে হচ্ছে?
না। অন্ততঃ পক্ষে দুই মাইল দূরে রয়েছে এখন সিংহটা।
বাব্বা! মহুয়া একটা হাঁফ ছাড়ে, এতদূর থেকেই এতো জোরে শোনা যায়, কাছে হলে না জানি কতো জোরে শোনা যাবে! আচ্ছা, এই, বলো না সিংহ গাছে চড়তে পারে?
না পারে না। শহীদ হাসলো। পারলেও চিন্তা কি? এতগুলো রাইফেল রয়েছে কি করতে?
মহুয়া চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর বোতল খুলে ঢক ঢক করে অনেকখানি জল খেলো। গফুর অন্যদিকে চেয়ে চুপ করে বসে রইলো। ও জানে দিদিমণির কতখানি ক্ষিধে পেয়েছে। সাথে খাবার নেই, সেজন্যে তার নিজেকে দোষী বলে মনে হতে লাগলো। সে কি করে দিদিমণির জল খেয়ে পেট ভরানো তাকিয়ে দেখবে?
বহুক্ষণ বসে রইলো তারা। শহীদ ঘুমানোর ব্যবস্থা করেছে। তিনজন ঘুমাবে ডালের সাথে বাঁধা অবস্থায়, আর একজন ঘন্টা তিনেক জেগে থাকবে। তারপর এক জনকে ঘুম থেকে উঠিয়ে নিজে ঘুমাবে।
গফুর বললো, আমিই প্রথম জাগি দাদামণি।
থাক। আর চালাকি করতে হবে না। আমাদের কাউকে জাগাতে আপনার হাত উঠবে না, তা ভালো করেই জানি আমি। নিজেই সারারাত জেগে থাকবার চেষ্টা করবেন, আর ঢুলতে ঢুলতে গাছ থেকে পড়ে গিয়ে বাঘের পেটে যাবেন। আমিই থাকবো প্রথম জেগে।
কিন্তু গফুর কিছুতেই শহীদকে জাগা রেখে ঘুমাবে না। কামাল আর মহুয়াকে ডালের সাথে পেঁচিয়ে বেঁধে ফেললো শহীদ।
আরও অনেকক্ষণ কাটলো। মহুয়া বোধকরি ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাৎ বেশ কাছেই ডিম্ ডিম্ করে ঢাক বেজে উঠলো। আশ্চর্য হয়ে গেল শহীদ। এতো রাতে এভাবে ঢাক বাজে কেন? কেমন একটু হৈচৈ-এর শব্দও যেন পাওয়া যাচ্ছে। জংলীরা কি টের পেলো যে ওরা এতো কাছেই গাছের ওপর রয়েছে?