ফিরবার সময় একবার নামবে না তোমরা?
দেখি, যদি ফিরতে পারি তাহলে চেষ্টা করবো।
কিন্তু তোমাদের ডাইভার কই?
তাই তো, এখনও ফিরলো না।
এমন সময় টলতে টলতে মি. ব্লাইদ এসে উপস্থিত হলো। হাতে একটা খোলা বোতলে কিছু অবশিষ্ট আছে। সেটুকু গলায় ঢেলে সশব্দে বোতলটা মাটিতে আছড়ে ভাঙলো ব্লাইদ। শহীদ বললো, আমরা এক্ষুণি রওনা হচ্ছি মি. ব্লাইদ। আপনি লঞ্চ ছাড়বার ব্যবস্থা করুন।
Oh; yes, certainly. (নিশ্চয়, নিশ্চয়।)
টলতে টলতে লঞ্চে উঠে গেল সে। শহীদ আর কুফুয়া একটু হাসলো ব্যাটা ইংরেজের বাচ্চার রস দেখে। শীষ দিতে দিতে চলেছে সে।
কুফুয়া বললো, আমি বুড়ো হয়ে গেছি তাই তোমাদের সঙ্গে গেলাম না। গেলে সুবিধা না হয়ে অসুবিধাই হতো তোমাদের। এখানকার আর কোনও লোককেও সঙ্গে দিতে চাই না। নিজের ছেলেকে দিয়ে বিশ্বাস নেই, অন্যকে বিশ্বাস করবো কি করে। কিন্তু এই চার্টটা তোমাকে দিচ্ছি, এতে তোমার উপকার হতে পারে। চার ভাঁজ করা। একটা কাগজ শহীদের হাতে দিলো কুফুয়া।
বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে শহীদ লঞ্চে গিয়ে উঠলো। লঞ্চ ছেড়ে দিলো। কুফুয়া, তার স্ত্রী আর পেণ্ডা পাড়ে দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে লাগলো। শহীদরাও রুমাল দোলালো।
ভোর ছটায় বড় সুন্দর করে সূর্য উঠলো। রাতের সমস্ত ক্লান্তি, সব কষ্ট হরণ করে যেন প্রভাত এলো আশার বাণী নিয়ে। সবার মন থেকে সব রকম দুশ্চিন্তা মুছে গেল। সবাই প্রাণকুন্ত সজীব হয়ে উঠলো।
পাশে গভীর জঙ্গল। পরিষ্কার জলে অজস্র কুমীর দেখা যাচ্ছে। ভয়ঙ্কর তাদের চেহারা। আর সুন্দর করে উঠেছে সূর্য। ভয়ঙ্কর আর সুন্দর। দুটো একসাথে মিশলেই হয় সত্যিকার সৃষ্টি। ভয়ঙ্কর সবসময় সুন্দর, আর সৌন্দর্যের মধ্যে ভয় না থাকলে তা অপরিপূর্ণ।
মৃদু একটা এঞ্জিনের শব্দ। জল কেটে তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছে লঞ্চ সমান গতিতে। কুল কুল করে ছোটো ছোটো ঢেউ লঞ্চের গায়ে এসে আছড়ে পড়ে। গত রাতের সে রোমাঞ্চকর ঘটনার কথা মনে পড়লে এখন হাসি পায়, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে না।
লঞ্চ একটু ধীরে ধীরে চালানো হচ্ছে। শীতকালে Gungunyaras Ford এর পশ্চিমে আর যাওয়া যায় না। এখন ভরা বর্ষা। বোঙ্কারা পর্যন্ত অনায়াসে যাওয়া যাবে। কিন্তু তবু সাবধানে চালানোই ভালো; বলা তো যায় না, কোথাও পাথর- টাথরে ঠোক্কর লেগে তলিয়ে যেতে পারে।
চা খেতে খেতে গল্প হয়। কামাল বলে, কিন্তু মহুয়া দি, চেকটা তো তোমার ভ্যানিটি ব্যাগের মধ্যেই ছিলো, গেল কোথায় ওখান থেকে?
মহুয়া হাসলো, ওই তো মজা! বলো তো কোথায় ছিলো? ওরা যখন অন্ধকার জায়গায় তোমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো, তখনই আমি বুঝেছিলাম ওদের কী মতলব। তাড়াতাড়ি চেকটা ব্যাগের পকেট থেকে বের করে কয়েক ভাঁজ করে বেণীর মধ্যে গুঁজে রেখেছিলাম।
সবাই হাসলো। শহীদ বললো, মেয়েমানুষ।
বেশ কিছুক্ষণ হলো সন্ধ্যা হয়েছে। কামাল সারাদিন হৈ-চৈ করেছে। মি. ব্লাইদের সাথে দোস্তি করে লঞ্চ চালানো শিখে নিয়েছে সে। এখন দেখা যায় বেশির ভাগ সময় সেই বসে আছে হাল ধরে, আর মি. ব্লাইদ পাশেই আধশোয়া হয়ে চোখ বুজে সিগারেট টানছে।
পাড়ে অনেক কুমীর শুয়ে থাকে। খালি কুমীর আর কুমীর। জলে স্থলে একেবারে গিজ গিজ করছে। কামাল তিনটাকে গুলি করে মেরেছে। শহীদ নিষেধ করলে বলে, হাত সই করছি। মহুয়া তার পয়েন্ট টুটু বোর রাইফেল দিয়ে হাঁস, গিনি ফাউল, পারট্রিজ যা পায় মারার চেষ্টা করে, কিন্তু লাগে না একটাও।
বিকেলের দিকে একটা মস্ত বড় রাজহাঁস একা উড়ে আসছিল পশ্চিম থেকে। দূর থেকে দেখতে পেয়ে মহয়ার রাইফেলটা নিয়ে গুলি করলো শহীদ। তার অব্যর্থ সন্ধান বিফল হলো না। ঘুরতে ঘুরতে রাজহাঁসটা নামতে লাগলো।
Excellent shot! মি. ব্লাইদ চিৎকার করে উঠলো। তারপর লঞ্চের মুখটা ঘুরিয়ে দিলো হাঁসটা যেখানে পড়ছে সেদিকে। কিন্তু আশ্চর্য, জলে পড়ার সাথে সাথেই তলিয়ে গেল হাঁসটা। সেখানকার জলে বেশ খানিকটা তোলপাড় হলো। কারও বুঝতে বাকি রইলো না ব্যাপারটা কি। সবাই একটু গম্ভীর হয়ে গেল। নদীর ভয়াবহতার স্পষ্ট প্রমাণ পেয়ে কারও মুখে কিছুক্ষণ কথা সরলো না।
সাঁঝের বেলা হঠাৎ গফুর পাড়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে চিৎকার করে উঠলো, দাদামণি, দেখো কি জিনিস।
সবাই ছুটে গেল লঞ্চের একধারে। দেখা গেল পাড়ের ওপর প্রকাণ্ড শরীরের কয়েকটা জন্তু দাঁড়িয়ে। লঞ্চের মৃদু শব্দ শুনে ওগুলো জলে নামবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। শহীদ বললো, হিপোপটেমাস।
কামাল ততক্ষণে রাইফেল তুলে নিয়েছে। শহীদ বললো, এই কামাল, মারিস না, এগুলো মারা নিষেধ।
দুত্তোর নিষেধ। থ্রি নট থ্রি রাইফেলের বিকট আওয়াজে আশেপাশে বন জঙ্গল কেপে উঠলো। ঝপ ঝুপ করে সব কটা জন্তু প্রচণ্ড আলোড়ন তুলে জলে নামলো। কেবল একটা স্থির হয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো, তারপর ধপাস করে কাত হয়ে জলে পড়লো।
রেগে গিয়ে শহীদ বললো, কেন শুধু শুধু মারলি? তোর কোনও ক্ষতি করছিল ওরা? সবকিছুতেই তোর বাড়াবাড়ি।
কামাল চুপ করে রইলো। কোনও উত্তর না দিয়ে ফিরে এসে চুপ করে বাইরের দিকে চেয়ে রইলো।
হঠাৎ শহীদ যেন কী একটা বুঝতে পারলো। প্রতিহিংসা নয় তো? কামালের বাবাকে এই লিষ্পোপোতেই কুমীরে ধরে নিয়ে গেছিলো। কামালের মনে কি তারই কোনও প্রতিক্রিয়া হয়েছে? অবচেতন মনে কুমীরের প্রতি তার জাত বিদ্বেষের সৃষ্টি হয়েছে হয়তো। তারই জন্যে খেপে গিয়ে সে কুমীর, হিপো যা পাচ্ছে মারছে। নইলে কামাল তো মনের দিক থেকে তার চাইতে অনেক বেশি নরম। শহীদের মনে পড়ে, কামালের শখের কুকুর বিড়াল বা কবুতর মারা গেলে এখনও সে কেমন ছেলে মানুষের মতো কাঁদে, সেই কামাল কি শুধু শুধু জন্তু জানোয়ার খুন করতে পারে?