রোয়েনা আর রেবেকাকে আলাদা করে নিয়ে যাওয়া হলো অন্যদের কাছ থেকে। ভিন্ন ভিন্ন দুটো প্রকোষ্ঠে আটকে রাখা হলো। মাটির নিচের অন্ধকার স্যাতসেঁতে একটি কুঠুরিতে আটকানো হলো বুড়ো আইজাককে। সেড্রিক আর অ্যাথেলস্টেনকে রাখা হলো এক কামরায়। আর চাকরবাঁকরদের সব পাঠিয়ে দেয়া হলো অন্য একটা ঘরে।
১৩. বেচারা আইজাক
বেচারা আইজাক! বরফের মতো ঠাণ্ডা তার ছোট্ট কুঠুরিটা। অন্ধকার আর স্যাতসেঁতে ভাব তো আছেই; আরো আছে ইঁদুর। সংখ্যায় অজস্র। এই অন্ধকুঠুরীতে আগে যেসব বন্দী মারা গেছে তাদের কঙ্কাল এখনো দেয়ালে ঝুলছে শেকলে বাঁধা অবস্থায়। ভয়, দুঃখ, হতাশা সব কিছু এক সাথে গ্রাস করেছে বুড়ো ইহুদীকে। এক কোণে হাঁটু দুটো বুকের সাথে ঠেকিয়ে বসে আছেন তিনি।
হঠাৎ লোহার ভারি দরজায় একটা শব্দ হলো। চমকে মুখ তুলে তাকালেন আইজাক। এক সেকেন্ড পর খুলে গেল দরজা। ভেতরে ঢুকলো রেজিনান্ড ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ। পেছনে কয়েকজন ভূত্য। বিরাট এক দাঁড়িপাল্লা, অনেকগুলো বাটখারা আর কয়েক ঝুড়ি কয়লা নিয়ে এসেছে তারা।
বিশালদেহী ফ্ৰঁত দ্য বোয়ে এগিয়ে এলো আইজাকের সামনে। ক্রূর দৃষ্টিতে তাকালো বৃদ্ধের দিকে। আতঙ্কে কেঁপে উঠলেন আইজাক সে দৃষ্টি দেখে।
দেখেছে দাঁড়িপাল্লা? শীতল কণ্ঠে বললো রেজিনাল্ড।
মাথা ঝাকালেন বৃদ্ধ, গলা দিয়ে কোনো স্বর বেরোলো না।
এই পাল্লায় তুমি আমাকে এক হাজার পাউন্ড রূপা ওজন করে দেবে। যদি না দাও, এই অন্ধকার কক্ষে তোমাকে তিলে তিলে মরতে হবে। ভেবো
আমি মিথ্যে ভয় দেখাচ্ছি, তোমার আগে অনেকেই মরেছে এখানে। দেয়ালের দিকে তাকাও, তাহলেই প্রমাণ পাবে। কেউ তাদের খবর পায়নি, আচমকা একদিন তারা হারিয়ে গেছে এ পৃথিবী থেকে। আমার আদেশ পালন না করলে তুমিও যাবে।
ওহ নবী আব্রাহাম! রুদ্ধশ্বাসে চিৎকার করে উঠলেন আইজাক। বিশ্বাস করুন এত রূপা আমার কাছে নেই। ইয়র্ক শহরে যত ইহুদী আছে সবার বাড়ি খুঁজলেও আপনি অত রূপা পাবেন না।
ভালো কথা, রূপা যদি না-ই প্লকে, সোনা দেবে।
দয়া করুন আমাকে, স্যার নাইট, কাতর কণ্ঠে বললেন আইজাক। আমি বুড়ো মানুষ, অসহায়, আমার কিছু নেই। বিশ্বাস করুন আমি কপর্দকশূন্য।
কপর্দকশূন্য! হাসলো রেজিনান্ড। ইয়র্কের আইজাক, কপর্দকশূন্য! পাগলেও তো বিশ্বাস করবে না। শোনো, আইজাক, তোমার সাথে রসের আলাপ করার সময় আমার নেই। যা চাইলাম দেবে কিনা বলল, না হলে তৈরি হও যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুর জন্যে।
বিশ্বাস করুন, অত টাকা–
শেষ করতে পারলেন না বৃদ্ধ। ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ ভৃত্যদের দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়লো, শুরু করো!
মেঝের ওপর এক ঝুড়ি কয়লা ঢেলে রাখলো এক ভৃত্য। অন্য একজন আরেকটা ঝুড়ি থেকে কয়েক টুকরো শুকনো কাঠ বের করে আগুন জ্বাললো চকমকি ঠুকে। জ্বলন্ত কাঠের ওপর মুঠো মুঠো কয়লা দিতে লাগলো প্রথম ভৃত্য, আর অন্যজন বাতাস করতে লাগলো হাতপাখা দিয়ে। দেখতে দেখতে গনগনে হয়ে জ্বলে উঠলো কয়লা।
দেখতে পাচ্ছো, আইজাক, আগুন? আগের মতোই শান্ত শীতল কণ্ঠে প্রশ্ন করলো রেজিনা। একটু পরেই ওর ওপর শুইয়ে দেয়া হবে তোমাকে। জ্যান্ত কাবাব বানানো হবে…।
না! না! চিৎকার করে উঠলেন আইজাক।
আরে, এখনই না না করছো কেন, সবটা তো এখনো বলিনি! মাংস যাতে ধীরে ধীরে পোড়ে সে জন্যে আমার চাকররা অল্প অল্প করে ঠাণ্ডা তেল ঢালবে তোমার ওপর।
না! না! না! রক্ত হিম করা স্বরে আর্তনাদ করে উঠলেন বৃদ্ধ।
ধরো তো ওকে!নির্দেশ দিলো ফ্ৰঁত দ্য বোয়েফ। ব্যাটা ইহুদীকে উলঙ্গ করে শুইয়ে দাও আগুনের ওপর!
সঙ্গে সঙ্গে ভৃত্যরা তৎপর হয়ে উঠলো আদেশ পালন করার জন্যে। নরম্যান লোকটার মুখের দিকে তাকালেন আইজাক। দয়া বা মায়ার লেশমাত্র দেখতে পেলেন না সে মুখে।
দেবো! আমি দেবো! ভূত্যদের সাথে ধস্তাধস্তি করতে করতে তিনি বললেন।
থামো তোমরা! ভৃত্যদের দিকে ফিরে হাঁক ছাড়লো রেজিনাল্ড। এই তো পথে এসেছো বাছা!
এক হাজার পাউন্ড রূপাই আমি দেবে আপনাকে। কিন্তু আগে তা আমাকে জোগাড় করতে হবে ইয়র্কের অন্য ইহুদীদের কাছ থেকে। সেজন্যে কয়েক দিন সময় দিতে হবে আমাকে। আমাকে ছেড়ে দিন, সব জোগাড় করে পৌঁছে দেবো এখানে।
আহ্লাদের আর জায়গা পাওনি, ইহুদী কুত্তা? রূপা বা সোনা যা-ই হোক আগে আমার হাতে আসবে তারপর তোমাকে ছাড়ার প্রশ্ন।
তাহলে আমার মেয়ে রেবেকাকে ইয়র্কে যেতে দিন। ও টাকা জোগাড় করে নিয়ে আসবে।
রেবেকা? অসম্ভব! রেবেকাকে ধরেছে বোয়া-গিলবার্ট। ও-কিছুতেই ওকে ছাড়বে না।
রেবেকা বোয়া-গিলবার্টের বন্দী! ওহ নবী আব্রাহাম! ওহ ঈশ্বর! দুঃখে হতাশায় হৃদয়টা গুঁড়িয়ে যেতে চাইছে আইজাকের। রেজিনান্ডের পায়ের ওপর আছড়ে পড়ে কেঁদে উঠলেন তিনি। যা চেয়েছেন তার দশগুণ দেব! চান তো শত গুণ দেবো। কিন্তু কিন্তু আমার মেয়েটাকে বাঁচান! বাঁচান দয়া করে!
কি আশ্চর্য! আমি কি করে বাঁচাবো তোমার মেয়েকে? বললাম না, ও বোয়া-গিলবার্টের বন্দী!। মুহূর্তে ভয়, ভাবনা, দুশ্চিন্তা সব দূর হয়ে গেল বৃদ্ধের মন থেকে। সোজা হয়ে দাঁড়ালেন রেজিনান্ডের মুখোমুখি। চোখ রাখলেন ওর চোখের দিকে। তারপর শান্ত কণ্ঠে বললেন, রেবেকাকে যতক্ষণ না মুক্তি দিচ্ছো, ততক্ষণ এক পয়সাও পাবে না আমার কাছ থেকে।