অন্যদিকে বেশ কয়েকজন স্যাক্সন, নরম্যান, এবং বিদেশী নাইট গতকালের বিজয়ীর পক্ষ নিয়েছে। তরুণ নাইট কাল যে বীরত্ব দেখিয়েছে তাতে এই নাইটদের ধারণা হয়েছে ওর পক্ষে যোগ দিলেই জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
রোয়েনাকে দেখেই রাজপুত্র জন এগিয়ে গেলেন অভ্যর্থনা জানানোর জন্যে। নিজে সাথে করে নিয়ে গেলেন সৌন্দর্য ও প্রেমের রানীর জন্যে সাজিয়ে রাখা সিংহাসনের কাছে।
আপনাদের রানীকে সঙ্গ দিন, উপস্থিত সম্রান্ত ও অভিজাত মহিলাদের নির্দেশ দিলেন জন।
কিছুক্ষণের ভেতর দেখা গেল অনেক কজন সুন্দরী রমণী ঘিরে দাঁড়িয়েছে রোয়েনাকে। চাঁদের জ্যোৎস্নার কাছে যেমন তারারা সব ম্লান হয়ে যায় তেমনি রোয়েনার সৌন্দর্যের কাছে ম্লান হয়ে গেল সব রূপসীর রূপ। রোয়েনা আসন গ্রহণ করতেই দর্শকরা করতালি দিয়ে অভিনন্দিত করলো তাকে। সেই সাথে হর্ষোৎফুল্ল চিৎকার।
ঘোষকরা এগিয়ে এলো এবার। দর্শকদের দিকে তাকিয়ে নিস্তব্ধতা প্রার্থনা করলো তারা। তারপর উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করলো আজকের দিনের নিয়মাবলী।
আজ লড়াইয়ে তরবারি এবং বর্শা দুই-ই ব্যবহার করা যাবে। তাই কয়েকটা ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে প্রতিযোগীদের। তলোয়ার দিয়ে শুধু আঘাত করা চলবে, কোনো সময়ই তা প্রতিদ্বন্দ্বীর শরীরে বিদ্ধ করা যাবে না। নাইটরা ইচেছ করলে কুঠার ব্যবহার করতে পারবে, কিন্তু ছোরার ব্যবহার নিষিদ্ধ। কোনো যোদ্ধা ঘোড়া থেকে পড়ে গেলে মাটিতে দাঁড়িয়েও সে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে, তবে সেক্ষেত্রে প্রতিপক্ষকেও ঘোড়া থেকে নামতে হবে। ঘোড়ায় চড়ে কোনো নাইটই মাটিতে দাঁড়ানো প্রতিদ্বন্দ্বীকে কোনো রকম আঘাত করতে পারবে না। যদি কোনো নাইট পিছু হটতে হটতে নিজের তাঁবুর দিকে যেতে বাধ্য হয় এবং সেখানকার বেষ্টনী স্পর্শ করে তাহলে সে পরাজিত বলে গণ্য হবে। কোনো নাইট যদি ঘোড়া থেকে পড়ে আহত হয় বা কোনো কারণে নিজে নিজে উঠে দাঁড়াতে না পারে তাহলে তার অনুচর বা পার্শ্বচররা এসে তাকে তুলে নিয়ে যেতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে সেই নাইট পরাজিত বলে গণ্য হবে। পরাজিত নাইটদের ঘোড়া, বর্ম ও অস্ত্রশস্ত্র বিজয়ী নাইটদের প্রাপ্য হবে। রাজপুত্র জন যে মুহূর্তে প্রতিযোগিতা বন্ধের ইঙ্গিত করবেন সে মুহূর্তে লড়াই থামিয়ে দিতে হবে দুপক্ষকেই। কোনো নাইট যদি এ সব নিয়ম লঙ্ন করে তবে তাকে অযোগ্য ঘোষণা করা হবে এবং প্রতিযোগিতা থেকে বের করে দেয়া হবে।
ঘোষণা শেষ করে যার যার জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালো ঘোষকরা। তীরে এক সাথে বেজে উঠলো অনেকগুলো ট্রাম্পেট। ক্ষেত্ব এখন তৈরি প্রতিযোগিতার জন্যে।
দীর্ঘ সারি বেঁধে মাঠে প্রবেশ করলে স্যার ব্রায়ান দ্য বোয়া-গিলবার্ট ও তার চব্বিশজন সহযোগী। দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দুই সারিতে দাঁড়িয়ে পড়লো তারা। এক সারির পেছনে আরেকটা। দলপতি দাঁড়িয়েছে সামনের সারির ঠিক মাঝখানে।
এরপর প্রবেশ করলো গৃহহীন নাইট, মাঠের অন্যপ্রান্ত দিয়ে। সঙ্গে তার চব্বিশ সহযোগী। তারাও একইভাবে দুই সারিতে ভাগ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
অভূতপূর্ব একটা দৃশ্য! পঞ্চাশ জন সাহসী নাইট অপেক্ষা করছে ঘোড়ার পিঠে বসে। প্রত্যেকের হাতে বর্শা। বর্শার মাথায় বাঁধা রঙচঙে পতাকাগুলো উড়ছে বাতাসে। বর্শার ফলাগুলো রোদ পড়ে ঝিক করে উঠছে। রোদ প্রতিফলিত হচ্ছে তাদের শিরোম্রাণে, বর্মে। ঘোড়াগুলো অস্থির। পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করছে একটু পরপরই। যেন ছুটবার জন্যে ছটফট করছে।
ল্যাইসে অ্যালের! অবশেষে রাজপুত্রের নির্দেশে ঘোষণা করলেন প্রধান বিচারক।
শুরু হয়ে গেল প্রতিযোগিতা।
দুই দলেরই সামনের সারির নাইটরা ছুটলো প্রতিপক্ষের দিকে। প্রত্যেকেই আক্রমণের ভঙ্গিতে বাগিয়ে ধরেছে বর্শা। মাঠের ঠিক মাঝখানে এমন ভয়ঙ্কর শব্দ তুলে তারা মিলিত হলো, এক মাইল দূর থেকেও শোনা গেল সে শব্দ। প্রথম কয়েক মিনিট ধুলায় প্রায় কিছুই দেখতে পেলো না দর্শকরা। ধুলার মেঘ যখন কেটে গেল, তারা দেখলো, দু পক্ষেরই অন্তত অর্ধেক নাইট পড়ে গেছে ঘোড়া থেকে। কয়েকজনের অবস্থা শোচনীয়। মৃতের মতো পড়ে আছে মাটিতে। বাকিদের বেশির ভাগই মারাত্মক আহত। তারা ঔড়ি মেরে দূরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করছে। যারা এখনো ঘোড়ার পিঠে অক্ষত অবস্থায় আছে তারা লড়ছে প্রতিপক্ষের সাথে। সবার হাতে এখন তলোয়ার, কারণ সবারই বর্শা ভেঙে গেছে প্রথম সংঘর্ষের সময়। দুপক্ষ থেকেই বয়ে যাচ্ছে চিৎকার আর মুখখিস্তির ঝড়।
এবার দ্বিতীয় সারির যোদ্ধারা এগোলো। ফলে লড়াইয়ের তীব্রতা বেড়ে গেল বহুগুণ। দুপক্ষেরই সমর্থকরা চিৎকার করে উৎসাহ দিচ্ছে যার যার, পছন্দের যোদ্ধাকে।
দেসদিচাদো! দেসদিচাদো! তরুণ নাইটের সমর্থকরা চিৎকার করছে।
বোয়া-গিলবার্ট! বোয়া-গিলবার্ট! চিৎকার করছে প্রতিপক্ষ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ভয়ঙ্কর রূপ নিলো যুদ্ধ। নাইটরা মাঠের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতে লাগলো প্রতিদ্বন্দ্বীদের। চিৎকার, গালাগালি, অস্ত্রের ঝনঝনানি আর ঘোড়ার খুরের শব্দে কান পাতা দায়। এর ভেতর থেকে থেকে বেজে উঠছে ট্রাম্পেট। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে আহতদের আর্তনাদ। সব মিলিয়ে বীভৎস দৃশ্য।