তাব, মোৎসার্ট কি-না লম্বাঝুল তোফা ফ্রকফোটে আমাদের শতকেও নাছোড়বান্দার মতো টিকে আছেন, এখনো বাহারি সাজে জমকালো, পরিপাটি পূর্ণাঙ্গ সংগীতে; বিগত শতক জুড়ে, মনে হয়, আর কোনো আওয়াজও বুঝি বা কানে আসে নি।
.
হিমুর মধ্য দুপুর
গৃহভৃত্য বিষয়ে আমার বাবার কিছু উপদেশবাণী ছিল। উপদেশবাণীর সার অংশ হচ্ছে— মহাপুরুষদের কিছুকাল গৃহভৃত্য হিসেবে থাকতে হবে। তিনি ডায়েরিতে কি লিখে গেছেন হুবহু তুলে দিচ্ছি। এই অংশটি তিনি মৃত্যুর আগে হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে লিখেছেন। হাতের লেখা জড়ানো এবং অস্পষ্ট। মানুষের মানসিক অবস্থার ছাপ পড়ে হাতের লেখায়। আমার ধারণা তখন তার মানসিক অবস্থাও ছিল এলোমেলো। লেখার শিরোনাম হিজ মাস্টার্স ভয়েস। তিনি সব লেখাই সাধু ভাষায় লেখেন। এই প্রথম সাধু বাদ দিয়ে চলিত ভাষা ব্যবহার করেছেন।
হিজ মাস্টার্স ভয়েস হিমু, তুমি নিশ্চয় রেকর্ড কোম্পানি হিজ মাস্টার্স ভয়েসের রেকর্ড দেখেছ। তাদের মনোগ্রামে একটি কুকুরের ছবি আছে। কুকুরটা থাবা গেঁড়ে তার মনিবের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে প্রভুর প্রতি আনুগত্য ঝরে ঝরে পড়ছে।
সব মহাপুরুষদের কিছু দিন কুকুর জীবন যাপন করা বাধ্যতামূলক। সে একজন প্রভুর অধীনে থাকবে। প্রভুর কথাই হবে তার কথা। প্রভুর আদেশ পালনেই তার জীবনের সার্থকতা। প্রভুর ভাবনাই হবে তার ভাবনা। প্রভু মিথ্যা বললে সেই মিথ্যাই সে সত্য বলে ধরে নিবে।
কুকুর ট্রেনিং-এ উপকার যা হবে তা নিম্নরূপ :
ক. জীবনে বিনয় আসবে। বিনয় নামক এই মহৎ গুণটি আয়ত্ত করা প্রায় অসম্ভব। আমি অতি বিনয়ী মানুষকেও দেখেছি অহংকারের গুদাম। সেই গুদাম তালাবদ্ধ থাকে বলে কেউ তার অহংকার প্রত্যক্ষ করতে পারে না।
খ. আনুগত্য কি তা শেখা যাবে। প্রতিটি মানুষ নিজের প্রতিই শুধু অনুগত। অন্যের প্রতি নয়। নিজের প্রতি আনুগত্য যে সর্বজনে ছড়িয়ে দিতে পারবে সেই তো মহামানব।
গ. মানুষকে সেবা করার প্রথম পাঠের শুরু।
কুকুর ট্রেনিং কিংবা গৃহভৃত্য ট্রেনিং তোমাকে সেবা নামক আরেকটি মহৎ গুণের সংস্পর্শে আনবে। ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল না, তোমাকে সত্যি সেবা শিখতে হবে। ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল অসুস্থ মানুষদের সেবা করতেন। তারা এমনিতেই সেবার দাবিদার। তোমাকে সুস্থ মানুষকে সেবা করতে হবে।
আমি নিজে এখন অসুস্থ। সময় ঘনিয়ে আসছে এইরূপ মনে হয়। তোমাকে পূর্ণাঙ্গ ট্রেনিং দিয়ে যেতে পারব বলে মনে হচ্ছে না। যেসব শিক্ষা দিয়ে যেতে পারব না, আমার আদেশ, সেসব শিক্ষা নিজে নিজে গ্রহণ করবে।
এখন অন্য বিষয়ে কিছু কথা বলি— গত শু দুপুরে আমি তোমার মাকে স্বপ্নে দেখেছি। স্বপ্ন মোটেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। মানুষ যখন নিদ্রা যায় তখন মস্তিষ্ক তার স্মৃতিগুলো নাড়াচাড়া করে। যাচাই-বাছাই করে, কিছু পুনর্বিন্যাস করে, তারপর স্মৃতির ফাইলে যত্ন করে রেখে দেয়। এই কাজটা সে করে যখন মানুষ ঘুমিয়ে থাকে তখন। মস্তিষ্কের এই কাজ-কর্মই আমাদের কাছে ধরা দেয় স্বপ্ন হিসেবে। ফ্রয়েড সাহেব বলেছেন, সব স্বপ্নের মূলে আছে যৌনতা। এই ধারণা যে কতটা ভুল তা ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না।
যাই হোক, এখন স্বপ্নের কথা বলি। আমি তোমার কিশোরী মাকে স্বপ্নে দেখলাম। এটা কীভাবে সম্ভব হলো জানি না। কারণ তাকে আমি কিশোরী অবস্থায় কখনো দেখি নাই। যখন তাকে বিবাহ করি তখন তার বয়স বাইশ। সে একজন তরুণী।
আমি দেখলাম সে তার গ্রামের বাড়িতে। কুয়ার পাড়ে বসে। আছে। তার সামনে এক বালতি পানি। সে চোখেমুখে পানি দিচ্ছে। তোমার মা অতি রূপবতীদের একজন এই তথ্য মনে হয় তুমি জান না। কারণ, তার মৃত্যুর পর আমি তার সমস্ত ফটোগ্রাফ নষ্ট করে দিয়েছি। তার স্মৃতিজড়িত সব কিছুই ফেলে দেয়া হয়েছে। কারণ স্মৃতি মানুষকে পিছনে টেনে ধরে। মহাপুরুষদের পিছুটান থেকে মুক্ত থাকতে হয়।
স্বপ্নের প্রসঙ্গে ফিরে যাই। তোমার মা চোখেমুখে পানি দিয়ে উঠে দাঁড়ানো মাত্র আমি সেখানে উপস্থিত হলাম। তোমার মা অত্যন্ত আনন্দিত গলায় বলল, তুমি একা এসেছ, আমার ছেলে কই?
আমি বললাম, তাকে ঢাকা শহরে রেখে এসেছি।
সে করুণ গলায় বলল, আহার, কত দিন তাকে দেখি না! সে। -কি হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটে। এটা কি সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি।
তুমি তাকে সুন্দর একটা শার্ট কিনে দিও। একটা প্যান্ট কিনে দিও। এক জোড়া জুতা কিনে দিও।
আচ্ছা দিব।
তোমার মা তখন কাদতে শুরু করে এবং কাদতে কাদতে বলল, ওর কি কোনো মেয়ের সঙ্গে ভাব হয়েছে? কোনো মেয়ে কি ভালোবেসে তার হাত ধরেছে?
আমিবললাম, না। সে মহাপুরুষ হওয়ার সাধনা করছে। তার জন্যে নারীসঙ্গ নিষিদ্ধ।
তোমার মা চোখের পানি মুছে রাগী রাগী গলায় বলল, সে মহাপুরুষ হওয়ার সাধনা করছে, না কচু করছে। তাকে তুমি আমার কাছে নিয়ে আস। আমি থাবড়ায়ে তার মহাপুরুষগিরি ছুটায়ে দিব।
স্বপ্নের এই জায়গায় আমাৱ ঘুম ভেঙে গেল।
স্বপ্ন যে এক ধরনের ভ্রান্তি তা আমি জানি। তারপরেও স্বপ্নদর্শনের পর পর আমার মধ্যে কিছু আচ্ছন্ন ভাব দেখা দিল। আমার চক্ষু সজল হলো। মনে মনে বললাম,
মাতা যস্য গৃহেনাস্তি
অরণ্যং তেন গন্তব্যং
যথারণ্যং তথা গৃহস।