প্রিয় পুত্র, তোমাকে অনেক দূর যাইতে হইবে। ইহা স্মরণ রাখিয়া অগ্রসর হইও। প্রকৃতি তোমার সহায় হউক— এই শুভ কামনা।
প্রিয় পুত্র,
মানুষ মায়াবদ্ধ জীব। মায়ায় আবদ্ধ হওয়াই তাহার নিয়তি। তোমাকে আমি মায়ামুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়া বড় করিয়াছি। তারপরেও আমার ভয়— একদিন ভয়ঙ্কর কোনো মায়ায় তোমার সমস্ত বোধ, সমস্ত চেতনা আচ্ছন্ন হইবে। মায়া কূপবিশেষ, সে-কূপের গভীরতা মায়ায় য়ে আবদ্ধ হইবে তাহার মনের গভীরতার উপর নির্ভরশীল। আমি তোমার মনের গভীরতা সম্পর্কে জানি। কাজেই ভয় পাইতেছি— কখন-না তুমি মায়া নামক অর্থহীন কূপে আটকা পড়িয়া যাও। যখনই এইরূপ কোনো সম্ভাবনা দেখিবে তখনই মুক্তির জন্য চেষ্টা করিবে। মায়া নামক রঙিন কূপে পড়িয়া জীবন কাটানোর জন্যে তোমার জন্ম হয় নাই। তুমি আমার সমগ্র জীবনের সাধনাকে নষ্ট করিও না।…
আমি আমার অপ্রকৃতিস্থ পিতার সমগ্র জীবনের সাধনাকে নষ্ট করি নি। আমি যখনই মায়ার কূপ দেখেছি তখনই দূরে সরে গেছি। দূরে সরার প্রক্রিয়াটি কত যে কঠিন তা কি আমার অপ্রকৃতিস্থ দার্শনিক পিতা জানতেন? মনে হয় জানতেন না। জানলে মায়ামুক্তির কঠিন বিধান রাখতেন না।
.
হিমুর দ্বিতীয় প্রহর
ভয় বিষয়ক উপদেশ একজন মানুষ তার এক জীবনে অসংখ্যবার তীব্র ভয়ের মুখোমুখি হয়। তুমিও হইবে। ইহাই স্বাভাবিক। ভয়কে পাশ কাটাইয়া যাইবার প্রবণতাও স্বাভাবিক প্রবণতা। তুমি অবশ্যই তা করিবে না। ভয় পাশ কাটাইবার বিষয় নহে। ভয় অনুসন্ধানের বিষয়। ঠিকমতো এই অনুসন্ধান করিতে পারিলে জগতের অনেক অজানা রহস্য সম্পর্কে অবগত হইবে। তোমার জন্য ইহার প্রয়োজনীয়তা আছে। তবে তোমাকে বলিয়া রাখি, এই জগতের রহস্য পেয়াজের খোসার মতো! একটি খোসা ছাড়াইয়া দেখিবে আরেকটি খোসী। এমনভাবে চলিতে থাকিবে— সবশেষে দেখিবে কিছুই নাই। আমরা শূন্য হইতে আসিয়াছি, আবার শূন্যে ফিরিয়া যাইব। দুই শূন্যের মধ্যবর্তী স্থানে আমরা বাস করি। ভয় বাস করে দুই শূন্যে। এর বেশি এই মুহূর্তে তোমাকে বলিতে ইচ্ছা করি না।।
নিদ্রা ও জাগরণের যে বাঁধাধরা নিয়ম আছে, যেমন দিবসে জাগরণ নিশাকালে দ্বিা— এসব নিয়ম মানিয়া চলার কোনো আবশ্যকতা নাই। কোনোরকম বন্ধনে নিজেকে বাঁধিও না। খোলা মাঠ বা প্রান্তরে নিদ্রা দিতে চেষ্টা করিবে। কোনো প্রকোষ্ঠে শয়ন করিলে সেই প্রকোষ্ঠের দরজা-জানালা সবই খুলিয়া রাখিবে যেন নিদ্রাকালে খোলা প্রান্তরের সহিত তোমার দ্ৰিীকক্ষের যোগ সাধিত হয়।
নিদ্রাকালে তঙ্কর বা ডাকাত আসিয়া তোমার মালামাল নিয়া পলায়ন করিবে— এই চিন্তা মাথায় রাখিও না, কারণ তঙ্কর আকর্ষণ করিবার মতো কিছু তোমার কখনই থাকিবে না। যদি থাকে তবে তাহা তঙ্কর কর্তৃক নিয়া যাওয়াই শ্রেয়।
.
জগতের কর্মকাণ্ড চক্ষু মেলিয়া দেখিয়া যাইবে। কোনোক্রমেই বিচলিত হইবে না। আনন্দে বিচলিত হইবে না, দুঃখেও বিচলিত হইবে না। সুখ-দুঃখ এইসব নিতান্তই তুচ্ছ মায়া। তুচ্ছ মায়ায় আবদ্ধ থাকলে জগতের প্রধান মায়ার স্বরূপ বুঝিতে পারিবে না।
যখনই সময় পাইবে তখনই বনভূমিতে যাইবার চেষ্টা করিবে। বৃক্ষের সঙ্গে মানবশ্রেণীর বন্ধন অতি প্রাচীন। আমার ধারণা আদি মানব একপর্যায়ে বৃক্ষের সহিত কথোপকথন করিত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের এই ক্ষমতা নষ্ট হইয়াছে। তবে সাধনায় ফল হয়। মন কেন্দ্রীভূত করিতে যদি সক্ষম হও তবে বৃক্ষের সহিত যোগাযোগেও সক্ষম হইবে। বৃক্ষরাজ তোমাকে এমন অনেক জ্ঞান দিতে সক্ষম হইবে যে-জ্ঞান এম্নিতে তুমি কখনো পাইবে না।
কণ্টক
কাঁটা, কণ্টক, শলা, তরুনখ, সূচী, চোঁচ
বাবা হিমালয়, শৈশবে কইমাছের ঝোল খাইতে গিয়া একবার তোমার গলায় কই মাছের কাঁটা বিঁধিল। তুমি বড়ই অস্থির হইলে। মাছের কাটার যন্ত্রণা তেমন অসহনীয় নয়, তবে বড়ই অস্বস্তিকর। কণ্টক নীরবেই থাকে, তবে প্রতিনিয়তই সে তার অস্তিত্ব স্মরণ করাইয়া দেয়। কণ্টকের এই স্বভাব তোমাকে জানাইবার জন্যই আমি তোমার গলার কাঁটা তুলিবার কোনো ব্যবস্থা করি নাই। তুমি কিছুদিন গলায় কাঁটা নিয়া ঘুরিয়া বেড়াইলে। বাবা হিমালয়, তুমি কি জান যে মানুষের মনেও পরম করুণাময় কিছু কাঁটা বিধাইয়া দেন? একটি কাটার নাম,— মন্দ কাঁটা। তুমি যখনই কোনো মন্দ কাজ করিবে তখনই এই কাঁটা তোমাকে স্মরণ করাইয়া দিবে। তুমি অস্বস্তি বোধ করিতে থাকিবে। ব্যথা বোধ না— অস্বস্তিবোধ।।
সাধারণ মানুষদের জন্য এইসব কার্টার প্রয়োজন আছে। সিদ্ধপুরুষদের জন্য প্রয়োজন নাই। কাজেই কন্টকমুক্তির একটা চেষ্টা অবশ্যই তোমার মধ্যে থাকা উচিত। যেদিন নিজেকে সম্পূর্ণ কন্টকমুক্ত করিতে পারিবে সেই দিন তোমার মুক্তি। বাবা হিমালয়, প্রসঙ্গক্রমে তোমাকে একটা কথা বলি, মহাপাষণ্ডরাও কণ্টকমুক্ত। এই অর্থে মহাপুরুষ এবং মহাপাষত্রে ভিতরে তেমন কোনো প্রভেদ নাই।
.
হিমুর রূপালী রাত্রি
বাবা হিমালয়,
হিন্দুনারী সম্পর্কে একটি বহু প্রচলিত লোক-শ্লোক আছে—
পুড়ল কন্যা
উড়ল ছাই
তবেই কন্যার
গুণ গাই।
অর্থাৎ কন্যার দাহকার্য সম্পন্ন না-হাওয়া পর্যন্ত তার গুণকীর্তন করা যাবে না। মৃত্যুর আগমুহূর্তেও তার পা পিছলাতে পারে। সে ধরা দিতে পারে প্রলোভনের ফাঁদে। পা রাখতে পারে চোরাবালিতে।