আমি বললাম, দিনক্ষণ বলুন। যথাসময়ে উপস্থিত থাকব। কোনো উপলক্ষ কি আছে?
উপলক্ষ আছে।
জুয়েল আইচ উপলক্ষ ব্যাখ্যা করলেন। তার এক বন্ধু এসেছেন কোলকাতা থেকে, নাম রঞ্জন সেনগুপ্ত। ভদ্রলোক একজন শিল্পপতি। তিনি লেখক হুমায়ূন আহমেদের কিছু রচনা পাঠ করেছেন। তার শখ লেখকের সঙ্গে কথা বলবেন।
আমি নির্দিষ্ট দিনে ঢাকা ক্লাবের রিসিপশন রুমে উপস্থিত হলাম। জুয়েল আইচ তার বন্ধুকে নিয়ে আগেই উপস্থিত। রিসিপশনের যিনি প্রধান, তিনি কেমন অদ্ভুত চোখে তাকাচ্ছেন। প্রথমে মনে হলো লেখককে চিনতে পারার আনন্দের জন্যেই তার চোখের দৃষ্টি অদ্ভুত লাগছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার ভুল ভাঙল। রিসিপশনিস্ট বিনয়ের সঙ্গেই বললেন, স্যার আপনাকে ক্লাবে ঢুকতে দেয়া যাবে না। সরি।
আমি বললাম, কেন?
আপনার ড্রেসকোড ঠিক নেই। আপনার পায়ে স্যান্ডেল। শার্ট যেটা পরেছেন সেখানেও সমস্যা।
জুয়েল আইচ নানা চেষ্টা চরিত্র করছেন। ক্লাবের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন, কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।
আমি বুঝতে পারছি, আমাকে দেখাচ্ছে লেবেনডিসের মতো। গায়ে ইস্ত্রিবিহীন কুঁচকানো শার্ট। পায়ে স্যান্ডেল। স্যান্ডেলের আয়ুও শেষ পর্যায়ে। যে-কোনো সময় চামড়ার ফিতা খুলে সে রিটায়ারমেন্টে চলে যাবে।
আমার সামনে রিসিপশনের একজন একজোড়া জুতা এনে রাখল। সেই জুতা গামা পালোয়ানের পায়েরও তিন চার সাইজ বড়। আমাকে বলা হলো– এই জুতা পরে ঢুকে যান।
আমি বললাম, অন্যের জুতা পরে কেন ঢুকব? খালি পায়ে কি ঢুকতে পারি? আমার খালি পায়ে ঢুকতে আপত্তি নেই। আমার উপন্যাসের এক চরিত্র হিমু, খালি পায়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল।
রিসিপশনিস্ট বলল, জ্বি-না স্যার। খালি পায়ে ঢুকতে পারবেন না।
আমি বললাম, আচ্ছা মহাত্মা গান্ধী তো আধা নেংটা থাকেন। ছাগলের দড়ি হাতে ঘুরে বেড়ান। ছাগলটা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করতে থাকে। মহাত্মা গান্ধী যদি ইচ্ছা প্রকাশ করেন ঢাকা ক্লাবের লাউঞ্জে বসে এক কাপ গরম দুধ খাবেন। তিনি কি পারবেন?
না। তাকে ঢুকতে দেয়া হবে না।।
রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তো আপনাদের ক্লাবে অনেক অনুষ্ঠান হয়। রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী। রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গান। হয় না?
জি স্যার হয়।
রবীন্দ্রনাথ যদি ক্লাবে আসতে চান, তাঁকে কি ঢুকতে দেয়া হবে? তিনি জোকাটাইপ পোশাক পরেন। পায়ে থাকে চপ্পল।
না উনাকেও ঢুকতে দেয়া হবে না।
আলবার্ট আইনস্টাইনকে কি ঢুকতে দেয়া হবে? ঢাকা ক্লাবের ড্রেসকোডের ধার কিন্তু তিনি ধারেন না।
স্যার, উনাকেও ঢুকতে দেয়া হবে না।
এতক্ষণে আমি কিছু স্বস্তি ফিরে পেয়েছি। এই গ্রহের সেরা তিনজনই যদি ক্লাবে ঢুকতে না পারেন, আমি কোথাকার হরিদাস পাল? আমাকে যে এরা কানে ধরে উঠবোস করায় নি এতেই আমি খুশি।
.
এই ঘটনার মাস ছয়েক পর আমি ঢাকা ক্লাব থেকে একটা চিঠি পেলাম। চিঠিতে লেখা, আমাকে ঢাকা ক্লাবের অনারারি মেম্বারশিপ দেয়া হয়েছে। এই খবর শুনে আমার বন্ধুরা এমন ভাব করতে লাগল যেন চব্বিশ ক্যারেট সোনার একটা হরিণছানা আমার ঘরে ঢুকে গেছে। ঢাকা ক্লাবের মেম্বারশিপের যে এত গুরুত্ব তা তো জানতাম না। আমি ক্লাব টাইপ মানুষ না। গুরুত্ব ধরতে পারার কথাও আমার না। আমি আমার নিজের ক্লাব সঙ্গে নিয়ে ঘুরি। যেখানে যাই ক্লাব সাথে নিয়েই যাই।।
যাই হোক, একদিন ঠিক করলাম মেম্বারশিপের শুভ উদ্বোধন করব। আমি আমার আরেক বন্ধু আর্কিটেক্ট করিমকে খবর দিলাম। সে ঢাকা ক্লাবের পুরনো মেম্বার। ক্লাবের নিয়মকানুন ভালো জানে। করিমকে সঙ্গে নিয়ে চামড়ার জুতা কিনলাম, ফুলহাতা শার্ট কিনলাম। ইন করে শার্ট পরব, কাজেই একটা বেল্টও কেনা হলো। আয়নায় তাকিয়ে দেখি নিজেকে সং-এর মতো লাগছে। সবাইকে সব কিছুতে মানায় না।
ক্লাবে ঢুকলাম। নতুন জুতার কারণে মেঝে অতিরিক্ত পিচ্ছিল লাগছিল। মনে হচ্ছিল যে-কোনো সময় আমি পিছলে গুরুত্বপূর্ণ কারো ঘাড়ে পড়ে যাব। একটা কেলেঙ্কারি হবে।
ইংরেজ সাহেবদের বানানো ক্লাব দেখে মুগ্ধ হলাম। চমৎকার মার্গারিটা পরপর কয়েকটা খেয়ে ফেললাম। সাহেবদের প্রতি একধরনের কৃতজ্ঞতাও বোধ করলাম। ভাগ্যিস তারা ক্লাব প্রজাতির ছিলেন।
পাখি উড়ে চলে গেলে পাখির পালক পড়ে থাকে। সাহেরা চলে গেছেন ফেলে রেখে গেছেন তাদের ছায়া। আমরা ক্লাবের মেম্বাররা সেই ছায়া গায়ে মেখে ক্লাবে ঢুকি। আড্ডা দেই। নিজেদের কেমন যেন ব্রিটিশ ব্রিটিশ লাগে। আমার মতো ভেতো বাঙালের জন্যে এও তো কম প্রাপ্তি না। আসুন এখন হিমুর বাবার পোশাক নিয়ে পুরনো নিয়মে প্রসেস অফ এলিমিনেশনের ভেতর দিয়ে যাই।
তিনি কি ছেলের মত হলুদ পাঞ্জাবী প্রবেন?
না।
তিনি কি থ্রি পিস স্যুট টাই পরবেন?
না।
লুঙ্গী গামছা?
না।
হাফপ্যান্ট, টি-শার্ট?
না।
মাওলানাদের পাঞ্জাবী, পায়জামা?
না। তিনি কি নগ্ন থাকবেন?
না।
পাঠক দেখছেন– তার পোশাক নির্বাচন কতটা জটিল হয়ে গেছে? তাকে সাধারণ হাওয়াই শার্ট এবং প্যান্ট পরানো ছাড়া গতি দেখছি না। পোশাকে তিনি হবেন সাধারণ। আইনস্টাইন টাইপ। আইনস্টাইনের পোশাক নিয়ে একটা গল্প কোথায় যে পড়েছিলাম। গল্পটা বলি। সুইডেনের রানীর সঙ্গে তার বৈঠক। রানী হঠাৎ লক্ষ্য করলেন আইনস্টাইনের শার্টের বোতাম ঠিকমত লাগানো নেই। দ্বিতীয় বোতামটি লাগানো হয়েছে তৃতীয় বোতাম ঘরে। রানী এই ত্রুটি থেকে কিছুতেই নিজের চোখ সরাতে পারছেন না। এক পর্যায়ে আইনস্টাইনের বিষয়টা চোখে পড়ল। তিনি লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, রানী দুমিনিট সময় দিন আমি বাথরুমে যাব এবং পোশাকের ত্রুটি দূর করে আসব।