চেয়ারে বসা থেকে ঝটু করে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলেন জানলার দিকে।
কি-ক্কি হয়েছে? ওদিকে কী দেখছেন? এইটুকু কোনোমতে বলতে পারলাম।
আপনি কি কিছুই দেখতে পাননি? উল্টে আমাকেই প্রশ্ন করলেন তিনি।
কই, নাতো৷ কিছুই দেখিনি। আপনি দেখেছেন? কি দেখেছেন?
স্পষ্ট কিছু দেখিনি। মনে হলো বাইরে কিছু একটা দ্রুত সরে গেল।
দোনলা বন্দুকটা তাক করে জানালার দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। আশপাশটা তীক্ষ্ণ চোখে দেখে নিয়ে হতাশ কণ্ঠে বললেন, কই, কিছুই তো দেখছি না!
হয়তো গাছের পাতা-টাতা নড়তে দেখেছেন। বাইরে যা ঝড়ের দাপট, এ অবস্থায় ভূতেরাও বেরুতে সাহস পাবে না। মোট পরিবেশটা হালকা করার জন্য বললাম আমি।
তা হতে পারে, বলে গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। মেঝে থেকে বইটা তুলে নিয়ে ফের পড়াতে মন দিতে চাইলেন। তা আর হলো না। থেকে থেকে অকারণেই তাঁর দৃষ্টি চলে যাচ্ছে জানালার দিকে। আমিও তাকিয়ে আছি ওদিকেই।
প্রকৃতির তাণ্ডব আরও বেড়ে গেল। ঝড়ের প্রচণ্ড গতি দেখে মনে হলো, উড়িয়ে নিয়ে যাবে বুঝি এই ঘরটাও। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল। সেই সঙ্গে মেঘের গর্জন। কান ফাটানো শব্দে আশেপাশে কোথাও বাজ পড়ল। বিদ্যুতের তীব্র ঝলকে ঝলসে গেল চোখ। পরমুহূর্তে শুরু হলো বড়ো বড়ো ফোঁটায় বৃষ্টি। সমানে বৃষ্টি, সেই সঙ্গে ঝড়ের প্রলয়ংকর তান্ডব চলল কয়েক ঘণ্টা ধরে।
ঈশ্বর, দ্বীপটা বুঝি ভেসেই গেল এবার, আপন মনেই বললেন ডাক্তার। এমন বৃষ্টি হতে কোনদিন দেখিনি। তবু ঈশ্বরকে ধন্যবাদ, অভিশপ্ত তৃতীয় রাতটা তো কেটে গেছে। ক্যাপ্টেন, দেখুন ভোর হয়ে গেছে। উচছুসিতভাবে বললেন তিনি, যাক, বোকা লোকগুলোকে তো বলতে পারব, দেখ বেঁচে আছি আমরা!
বাইরে তাকালাম। সত্যি সকাল হয়ে গেছে। থেমে গেছে বৃষ্টি। পরিষ্কার আকাশ। কলকল শব্দে গড়িয়ে চলেছে বৃষ্টির পানি। নদীতে গিয়ে পড়বে।
এতক্ষণ পর মনে পড়ল গেমককের কথা। সারারাত ভয়াবহ দুশ্চিন্তায় একটুও মনে পড়েনি ওটার কথা। এই বৃষ্টিতে ভেসে যায়নি তো জাহাজটা!
আমার শুকনো মুখ দেখে তিনি বললেন, কফি খাওয়া যাক। যা ধকল গেছে রাতভর।
কারখানা ছেড়ে খাবার ঘরে এসে ডাক্তার বললেন, আপনি অপেক্ষা করুন, আমি ওয়ালকারকে দেখে আসি।
ঘরের ভেতরটা আবছা অন্ধকার। স্পিরিট ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলাম কফি বানানোর জন্যে। চার-পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফিরে এলেন তিনি। ধপ করে বসে পড়লেন একটা চেয়ারে। দেখি তার চোখের কোণে চকচক করছে পানি।
কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে?
ডুকরে উঠলেন ডাক্তার, ও আর নেই!
ধক করে উঠল বুকের মধ্যে। কী বলছেন আপনি? মি. ওয়ালকার মারা গেছেন?
ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন তিনি। হ্যাঁ। মারা গেছে ওয়ালকার।
ডাক্তারকে অনুসরণ করে নিঃশব্দে ঢুকলাম শোবার ঘরে। আবছা অন্ধকার। বিছানায় শুয়ে রয়েছেন ওয়ালকার। মনে হচ্ছে যেন ঘুমাচ্ছেন।
সত্যি মারা গেছেন! বিশ্বাস করতে পারলাম না আমি।
কয়েক ঘণ্টা আগেই, শুকনো খসখসে কণ্ঠস্বর তার।
কিসে? জ্বরে?
না।
তাহলে?
ওর বুকে চাপ দিয়ে দেখুন?
বিছানার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দ্বিধা করলাম একবার। মি. ওয়ালকারের বুকে হাত রেখে আলতো চাপ দিলাম। চমকে গেলাম। একি! তুলতুলে নরম! যেন কাঠের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি একটা পুতুল!
ব্যাপার কী? অবাক হলে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
চুপ করে রইলেন তিনি।
কি, কিছু বুঝতে পেরেছেন?
ঘাড় নাড়লেন ডাক্তার। বোধহয় পারছি। আসুন আমার সঙ্গে, বলে দরজার দিকে এগোলেন তিনি।
দরজার বাইরে বেরিয়ে মাটির দিকে তাকালেন। মোটেও খোঁজাখুঁজি করতে হলো না। হাত তুলে দেখালেন তিনি। দরজার কাছ থেকে চলে গেছে মোটা একটা দাগ। যেন অনেক মোটা দমকলের পাইপ টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। ভেজা নরম মাটির ওপর দিয়ে।
আমি কিছু বুঝতে পারলাম না। কিসের দাগ?
আমার কথা যেন কানেই যায়নি ডাক্তারের। তাকিয়ে রয়েছেন বনের দিকে। দাগটা সেদিকেই চলে গেছে। জ্বলে উঠল তার চোখ। আমার দিকে ফিরে বললেন, এক মিনিট, আসছি। বলে তার ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। বেরিয়ে এলেন হাতে বন্দুক নিয়ে। বললেন, আসুন।
নীরবে তার সঙ্গে রওনা হলাম। দাগটা অনুসরণ করে চললেন তিনি। এঁকে বেঁকে চলে গেছে চিহ্ন। অনুসরণ করতে কোন অসুবিধে হলো না।
বেশি দূর যেতেও হলো না। বনের ভেতর শখানেক গজ এগিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন ডাক্তার। গাছপালা এখানে বেশ ঘন আর বড়ো বড়ো। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে এবার শুধু চোখ দিয়ে খুঁজতে লাগলেন তিনি। হঠাৎ ফিসফিসিয়ে বললেন, ওই দেখুন।
দেখলাম। ধক করে উঠল বুক। মোটা একটা ডালে জড়িয়ে রয়েছে। বিশাল কালো চকচকে একটা শরীর। মাথাটা বিরাট। গলার কাছটা ধূসর। ভয়ঙ্কর কুতকুতে দুটো চোখ। এত বড়ো সাপ আমি জীবনে দেখিনি।
আমাদের দেখেই পাক খুলতে শুরু করল সাপটা। মাথাটা ঝুলে পড়তে লাগল নিচের দিকে। শিকার দেখতে পেয়েছে। পুরোপুরি মানুষখেকো হয়ে গেছে ওটা।
দেরি করলেন না ডাক্তার। সোজা মাথাটা সই করে ট্রিগার টিপে দিলেন। ঝটকা দিয়ে দোলনার মতো দুলে উঠল একবার মাথাটা। তারপর পেন্ডুলামের মতো দুলতে লাগল এপাশ ওপাশ। মৃত্যুযন্ত্রণায় মোচড় খেতে গিয়ে আপনাআপনি খুলে গেল পাক। তারপর ঝুপ করে পড়ল মাটিতে।